আবার প্রমাণ হইল, কেন্দ্রীয় সরকারের কেন্দ্রীয় মানসিকতাটি পরিচালনামূলক নহে, দমনমূলক। নির্বাচিত হইয়া ক্ষমতায় আসা ইস্তক তাহাদের ভাবটি হইল, দেশের সব ক্ষমতা এখন তাহাদের হাতে: নাগরিকরা কী করিবে, কী পরিবে, কী খাইবে, কী বলিবে, কী ভাবিবে, সবই তাহাদের নিয়ন্ত্রণের অধীন। সরকারি দফতরে যে হাতে-গোনা কয়েক জন ব্যক্তি বসিয়া থাকেন, দফতরের বাহিরে কয়েক শত কোটি ব্যক্তির মত তাঁহারাই পেষণ করিতে পারেন, এবং নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন। এই যেমন, কোনও শিল্পকৃতি রচিত হইলে প্রথমেই তাঁহাদের বিবেচনার জন্য তাহা হাত জোড় করিয়া বসিবে, ইহাই দস্তুর। কাশ্মীরি যুবক চিত্রপরিচালক কাশ্মীর লইয়া তথ্যচিত্র বানাইলে তাহা দেখিতে বৃহত্তর সমাজের আগ্রহ আছে কি না, দেখিলে সমাজের ভাল হইবে না মন্দ হইবে, সবই তাঁহারা জানেন, তাঁহারাই ঠিক করিবেন। কেরলে আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র উৎসবে তিনটি চলচ্চিত্রের নাম এই কারণেই কাটা পড়িল। একটি কাশ্মীরের আন্দোলন বিষয়ক। একটি রোহিত ভেমুলার আত্মঘাত বিষয়ক। আর একটি জেএনইউ-এর মিছিল বিষয়ক।
তিনটি চলচ্চিত্রের বিষয়ের মধ্যে এক পরমাশ্চর্য সাদৃশ্য: প্রতিটিই বর্তমান সরকারের তীব্র সমালোচনা। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের বাহিরে অবশ্য সকলকে ধরিয়া লইতে হইবে, ইহা নিতান্ত সমানুপাত, আকস্মিক মিল। ইহার পিছনে বিজেপি সরকারের ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি খঁুজিতে নাই। তবে কিনা, মতাদর্শের বাহিরেও একটি বিষয়ে কাহারও আঘাত লাগিতে পারে। তাহা সরকারি কর্মপদ্ধতির অপরিসীম ঔদ্ধত্য। কখনও সরকার তথ্যচিত্র বন্ধ করিতেছে। কখনও গোমাংস বন্ধ করিতেছে। কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতা বন্ধ হইতেছে। আহত নাগরিকদের জ্ঞাতার্থে বলিতে হয়, মতাদর্শের উপরেও সরকারি প্রতাপ প্রদর্শনের আরও একটি বড় যুক্তি আছে। যাহা কিছু দেখিলে বা শুনিলে সমাজের চিত্ত অস্থির হইতে পারে, সমাজমনে অশান্তি ঢুকিতে পারে, তাহা বন্ধ করিবার দায়িত্ব তো সরকারেরই। অস্থিরতা সমাজের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল হইতে পারে না! আর সমাজের স্বাস্থ্যের দিকে সরকার লক্ষ না রাখিলে কে রাখিবে!
রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের উপর দিয়া এই নৈতিক অভিভাবকত্বের জন্ম হয় একটি নৈতিক মহত্ত্বের প্রত্যয় হইতে। বর্তমান সরকারের কাজেকর্মে প্রত্যহ এই প্রত্যয় পরিস্ফুট হইতেছে ঠিকই, তবে ইহাও সত্য যে, জন্মাবধি ভারতীয় রাষ্ট্র এই প্রত্যয়ে ভর করিয়াই পথ হাঁটিয়া আসিতেছে। কোন বই নিষিদ্ধ হইবে, কোন শিল্পী দেশ হইতে বহিষ্কার হইবেন, এই সব অভিভাবকত্বের দায় সানন্দে মাথায় তুলিয়া লইয়াছে। দোষ দেওয়া যায় না। জন্মের আগে হইতেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাছে সে শুনিয়া আসিতেছে: সরকার মা-বাপ, তাই সরকারের হুকুম, নিষেধাজ্ঞা, বেত্রাঘাত, নির্যাতন, সবই মাথা পাতিয়া লওয়া সমাজের কাজ। স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতীয় রাষ্ট্র হইতে এই নৈতিক মহত্ত্বের প্রত্যয়টি উত্তরাধিকার সূত্রে পাইয়াছে। কেবল মতাদর্শ নহে, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেও সমাজের ঊর্ধ্বে সরকারের অবস্থান তাই প্রথমাবধি প্রতিষ্ঠিত। তাই আফস্পার মতো চূড়ান্ত দমনমূলক ঔপনিবেশিক আইন দিয়া দশককাল ধরিয়া কাশ্মীরে ‘শান্তিপ্রতিষ্ঠা’, আবার কাশ্মীর-বিষয়ক চলচ্চিত্রকে ‘দেশদ্রোহিতা’ বা ‘সামাজিক অস্থিরতা’র আশঙ্কায় নিষিদ্ধ করা। এই নিষেধাজ্ঞাটিও ঔপনিবেশিক বিধি দ্বারাই নির্ধারিত, ব্রিটিশ আমলের রচনা যে বিধির আজও সংশোধন হয় নাই। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা যে এত সহজে বিপন্ন করা যাইতেছে, তাহা অহেতুক নহে। ভারতীয় রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যে যে সকল পুরাতন প্রহরা আগের মতোই প্রবল ও পরাক্রমী, দমন-নিয়ন্ত্রণের কাজটিকে তাহাই আজ সহজসাধ্য করিয়া দিতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy