এখনও টিকে আছে কিছু চণ্ডীমণ্ডপ। ছবি: লেখক
‘আমাদের চণ্ডীমণ্ডপ হইতে বিলাতি কারখানাঘরের প্রভূত জঞ্জাল যদি ঝাঁট দিয়া না ফেলি, তবে দুই দিক হইতেই মরিব— অর্থাৎ বিলাতি কারখানাও এখানে চলিবে না, চণ্ডীমণ্ডপও বাসের অযোগ্য হইয়া উঠিবে।’ তাঁর ‘‘আত্মশক্তি’ প্রবন্ধে উনিশ ও বিশ শতকের নগরায়ণ এবং গ্রামীণ সভ্যতার দ্বন্দ্বকে এ ভাবেই ধরতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু এই প্রবন্ধ নয়, রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ বা ‘চোখের বালি’-র মতো উপন্যাসে বা ‘ঘাটের কথা’, ‘সে’-র মতো গল্পে উঠে এসেছিল এই চণ্ডীমণ্ডপের কথা। রবীন্দ্রনাথের পরেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ উপন্যাসেও ‘গ্রামীণ জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ’ হিসেবে এসেছিল চণ্ডীমণ্ডপের কথা। মধ্যযুগের নানা কাব্যেও ফিরে ফিরে এসেছে এই চণ্ডীমণ্ডপের অনুষঙ্গ। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতিতে কী ভাবে এল এই চণ্ডীমণ্ডপের প্রসঙ্গ?
সমাজতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন, মধ্যযুগে দেবী চণ্ডীর পুজোর থান হিসেবে বাংলার বিভিন্ন গ্রামে মাথা তুলেছিল এই সব চণ্ডীমণ্ডপগুলি। মধ্যযুগে দেবী চণ্ডীর পুজো হত গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে। কালক্রমে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীদের মতো কবিদের হাত ধরে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বাঙালি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠতে থাকল। গ্রামের বিভিন্ন বিত্তশালী মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতায় একে একে চণ্ডীমণ্ডপ গড়ে উঠতে শুরু করল বাংলার বিভিন্ন গ্রামে।
মধ্যযুগের বাঙালি সংস্কৃতিতে চণ্ডীমণ্ডপ নিজেই একটি অধ্যায় ছিল। এই সময় গ্রামের বিচার থেকে শুরু করে বিনোদন— সবেরই প্রাণকেন্দ্র ছিল এই চণ্ডীমণ্ডপগুলি। বিনয় ঘোষের ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি ও সমাজতত্ত্ব’ বইটি থেকে জানা যায়, এই সব চণ্ডীমণ্ডপগুলিতেই এক কালে মঙ্গলচণ্ডীর গীতির পাশাপাশি, ভাগবত পাঠ থেকে শুরু করে পালগান কথকতা, পাঁচালি পাঠ —সবই আয়োজিত হত। এই প্রতিষ্ঠানটিই ছিল গ্রামের গুরুমশাইয়ের পাঠশালা এবং বাবুদের বিচারশালা।
অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত যে চণ্ডীমণ্ডপ গ্রামীণ সংস্কৃতির আধার ছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সেই চণ্ডীমণ্ডপগুলিই গুরুত্বহীন হয়ে উঠতে লাগল। এই সময় থেকেই রাঢ়বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করতে থাকে শহুরে সংস্কৃতির হাওয়া। ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, বণিক শ্রেণির উদ্ভব, জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি— প্রভৃতি কারণে গ্রাম বাংলায় চণ্ডীমণ্ডপগুলি তাদের কৌলীন্য হারাতে শুরু করল। প্রাচীন গ্রামজীবনের স্মারক হিসেবে যেগুলি দাঁড়িয়েছিল, কালক্রমে সেগুলির অধিকাংশই সংস্কারের অভাবে বা নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হতে শুরু করেছিল। তবে আজও বিভিন্ন প্রান্তের কিছু গ্রামের কড়িবর্গা দেওয়া বা বাঘ, সিংহ, হাতি আঁকা চণ্ডীমণ্ডপ ও আটচালার দেখা মেলে। এই সব আটচালাগুলি পুরনো দিনের স্মৃতিকে বহন করে নিয়ে চলেছে। পাঠশালা বা বিচারশালা আজকের যুগে অন্যত্র সরে গিয়েছে বটে তবে ক্ষেত্রবিশেষে অতীতকে বুকে নিয়ে দাঁডিয়ে থাকা আটচালাগুলি আজও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আজকের যুগের গ্রামগুলিতে প্রাচীন আটচালা খুবই কম দেখা যায়। চণ্ডীমণ্ডপের জায়গায় অধিকাংশ বয়স্কদের আড্ডা স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে ক্লাব বা গ্রামের খোলা প্রকৃতির বুকে। কোথাও আবার পুরনো দিনের পাকা চণ্ডীমণ্ডপগুলির চুনসুড়কির গাঁথনি পড়ে গিয়েছে। কোথাও আবার তাদের ভেঙে গডে তোলা হয়েছে দুর্গা, কালীর মতো দেবতার মন্দির।
আগেকার দিনের চণ্ডীমণ্ডপগুলির অধিকাংশই ছিল খড়ের আটচালা। দাঁইহাটের কাছে জগদানন্দপুরে এখনও খড়ের আটচালাবিশিষ্ট মণ্ডপ রয়েছে। গ্রামের বয়স্ক নাগরিকেরা এখনও সেখানে আড্ডা দেন নিয়মিত। এখানে এখনও হরিবাসর, অষ্টপ্রহর, নাম সঙ্কীর্তন আয়োজিত হয়। কেতুগ্রাম থানার পাণ্ডুগ্রামের আটচালায় এখনও নিয়ম করে সাতটি দুর্গার পুজো হয়। ভাতার থানার বলগনা গ্রামের গ্রাম দেবতা হনুমান। সেখানেও গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ম করে হনুমানের পুজো হয়ে আসছে বিগত কয়েক শতক ধরে। এই মণ্ডপটি তাই এখানে ‘হনুমান তলা’ নামে পরিচিত। এই গ্রামে উগ্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস বেশি। এই গ্রামে এখনও বেশ কিছু সমৃদ্ধ বাড়ির বৈঠকখানা লাগোয়া দুর্গামন্দিরের সঙ্গে আগেকার দিনের চণ্ডীমণ্ডপের কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই সব দুর্গামন্দিরগুলি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলেও একটা সময় এই সব মণ্ডপেও গ্রামীণ আড্ডার পরিবেশ বজায় ছিল।
দরজা লাগোয়া বৈঠকখানা এখনও বেশ কিছু গ্রামে দেখা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলিতে আড্ডা দেওয়া বা পুজোর পাট উঠে গেলেও এখন কয়েকটি ক্ষেত্রে সেগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে অস্থায়ী অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্র হিসেবে। কাটোয়ার গাফুলিয়া গ্রামের আটচালাটি অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রের পাশাপাশি বিবাহ, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কাজেও লাগে। পাণ্ডুগ্রামে মদনগোপলের মণ্ডপে আজও বছরভর নাম সঙ্কীর্তন, শাস্ত্রপাঠের আয়োজন করা হয়। তারই সঙ্গে সঙ্গে দোল উৎসবে গ্রামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষ এখানে এসে জড়ো হন। বর্ধমানের উত্তর রাঢ় অঞ্চলে চৈত্রমাসে শিবের গাজন উপলক্ষে বোলান পরিবেশিত হয় এই চণ্ডীমণ্ডপেই। তবে গ্রামের বয়স্করা জানান, শুধু পুজোর সময়েই নয়, বছরের অন্য দিনগুলিতেও বিকেলবেলা এখানে তাঁরা জমায়েত হন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য পাল্টে গিয়েছে চণ্ডীমণ্ডপ। বয়স্কদের আড্ডার বিষয়বস্তুও। তবে এখনও ছোটখাটো অপরাধ বা মনোমালিন্যগুলির মীমাংসা হয় এই পড়ে চণ্ডীমণ্ডপে। গ্রামের বয়স্কেরা আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে বিবাদ মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাই হয়তো যে সব গ্রামে চণ্ডীমণ্ডপ টিকে আছে সেখানে আটচালাগুলির বেশ গুরুত্বও রয়েছে।
তবে হ্যাঁ, আগের থেকে গ্রামীণ জীবন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে মানুষ শহর যাচ্ছেন। তাদের হাত ধরে গ্রামে প্রবেশ করছে নগর সংস্কৃতি। কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাও অনেকটা বদলে গিয়েছে। এখন চণ্ডীমণ্ডপে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শোনার থেকে তরুণ প্রজন্ম ডিজে ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনের বিনোদনের মাধ্যমও। তাই হয়তো উনিশ শতকের বিখ্যাত কবি ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান পূর্ব বর্ধমান জেলার গঙ্গাটিকুরি গ্রামের বয়স্ক নাগরিকেরা এখন চণ্ডীমণ্ডপ ছেড়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছেন গ্রামের একটি কালভার্টের ধারকে। তাঁদের থেকেই এক জন বলে উঠলেন, ‘‘আমরাই বোধহয় শেষ প্রজন্ম যাঁরা গ্রামের আটচালা ও চণ্ডীমণ্ডপ দেখেছি। আমাদের সঙ্গে সে স্মৃতি হারিয়ে যাবে।’’
লেখক মঙ্গলকোট একেএম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy