Advertisement
১১ মে ২০২৪
উদ্বাস্তুবিরোধিতায় ঘৃতাহুতি

নাগরিকত্ব বিলই প্রমাণ, রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা এখন শুধু ‘মিথ’

যা-ই হোক, আটঘাট বেঁধে অসমে রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতায় আসা ও গত বছরের ৩০ জুলাই এনআরসি-র দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশের পর একলপ্তে চল্লিশ লক্ষ লোকের (অধিকাংশই বাঙালি, যাঁদের মধ্যে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আবার নতুন করে জমা দিয়েছেন চূড়ান্ত খসড়ায় নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পাওয়ার আশায়) নাম না থাকার ঘোষণা অবধি তবু ঘটনার গতি-প্রকৃতি চেনা ছকে এগোচ্ছিল।

উদ্বেগ: জাতীয় নাগরিক পঞ্জি সহায়ক অফিসে নিজেদের কাগজপত্র নিয়ে দেখাচ্ছেন হাতিশোলা গ্রামবাসী, কামরূপ, অসম, ৮ ডিসেম্বর। এএফপি

উদ্বেগ: জাতীয় নাগরিক পঞ্জি সহায়ক অফিসে নিজেদের কাগজপত্র নিয়ে দেখাচ্ছেন হাতিশোলা গ্রামবাসী, কামরূপ, অসম, ৮ ডিসেম্বর। এএফপি

অনিন্দিতা ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

১৯৪৭ সালের দেশভাগের কিছু আগে থেকে ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটা হঠাৎ যেমন সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনই অসমের ক্ষেত্রে ২০১৫ সালে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবায়নের কাজ শুরু এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ নয়া ধারা সংযোজন সংক্রান্ত তর্ক-বিতর্কে ‘এনআরসি’ শব্দটিও এক বহুচর্চিত শব্দ হয়ে উঠেছে। গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তো বটেই, ভারতের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের অলিন্দেও গত এক বছর ধরে এই শব্দটির ক্রমাগত উচ্চারণ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাধারণ মানুষজন এই ভয়ঙ্কর শব্দটি যে আসলে ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েন্স’ বলে একটা রাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সারসংক্ষেপ, সেটা পর্যন্ত জানেন না। আর কেনই বা একে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয়-রাজ্য রাজনীতির আঙিনা বার বার সরগরম হয়ে উঠছে, তার কারণটাও হয়তো বোঝেন না। কিন্তু এত দিনে তাঁরা হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছেন যে, এই ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রে’ তাঁদের অস্তিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে এই শব্দটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে।

যা-ই হোক, আটঘাট বেঁধে অসমে রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতায় আসা ও গত বছরের ৩০ জুলাই এনআরসি-র দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশের পর একলপ্তে চল্লিশ লক্ষ লোকের (অধিকাংশই বাঙালি, যাঁদের মধ্যে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আবার নতুন করে জমা দিয়েছেন চূড়ান্ত খসড়ায় নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পাওয়ার আশায়) নাম না থাকার ঘোষণা অবধি তবু ঘটনার গতি-প্রকৃতি চেনা ছকে এগোচ্ছিল। কিন্তু গত ৯ জানুয়ারি লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে মাত্র একটি অধিবেশনেই লোকসভায় পাশ হয়ে গেল বিতর্কিত নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬। এই বিল ঠিক কী? বর্তমান রাজনীতিতে এর গুরুত্ব নিয়ে এত মাথাব্যথার কারণই বা কী? কেনই বা এই বিল পাশ করা নিয়ে এমন উত্তাল পরিস্থিতি গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে?

এই বিলের মাধ্যমে শর্ত-সাপেক্ষে সুরক্ষা এবং নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে মূলত পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী সংখ্যালঘুদের। কারা এই সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার হতে পারেন, সেই জনগোষ্ঠীর নামও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান এবং পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষ যদি ছ’বছর ধরে একটানা ভারতে বসবাস করার প্রমাণ দাখিল করতে পারেন, তবেই এই সংশোধনী বিলের মাধ্যমে তাঁরা এই দেশে নাগরিকত্বের জন্য বৈধ ভাবে আবেদন করতে পারবেন। এই বিল উত্থাপন অথবা পাশ করানোর পিছনে অনেক দিনের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা সংখ্যালঘু মানুষদের নাগরিক অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এই নাগরিক অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসমের উদ্বাস্তুদের নিয়ে সমস্যা থেকেই যাচ্ছিল। এই সমস্যার মূল কারণ হল, ১৯৮৫ সালের ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে স্বাক্ষরিত ত্রিপাক্ষিক অসম-চুক্তি। শুধু অসমের ক্ষেত্রে এই চুক্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনকে সংশোধন করে ১৯৮৫ সালেই ৬(ক) ধারা সংযোজিত হয়েছিল নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষের প্রশ্নে। বিদেশি শনাক্তকরণ এবং বিতাড়নের জন্য ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাতকে ভিত্তিতারিখ স্থির করা হয়। তাই, এই ৬(ক) ধারার সংশোধনের গেরো পার করতে না পারলে, এই নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৬ শেষ অবধি আইনে পরিণত হলেও অসমের উদ্বাস্তু বাঙালিদের ক্ষেত্রে এই বিলটির সাহায্য নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর আগে ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার দু’টি নোটিফিকেশন ও এই ডিসেম্বর মাসে আরও একটি উদ্বাস্তু নোটিফিকেশন জারি করেছিল— উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব অর্জনে সাহায্য করতে। কিন্তু অসম সরকার এর বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেনি। উপরন্তু রাজ্য সরকার গুয়াহাটি হাইকোর্টে হলফনামা দাখিল করেছিল এই মর্মে যে, দীর্ঘমেয়াদি ভিসা যত ক্ষণ পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে মঞ্জুর করা না হচ্ছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত অসমের এই বাঙালি ‘অ-নাগরিকরা’ উদ্বাস্তু নোটিফিকেশনের কোনও সুবিধা দাবি করতে পারবেন না।

এখন প্রশ্ন— রাজ্যসভায় এই বিতর্কিত বিলটি আদৌ পাশ হবে কি না, তার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা না থাকলেও অসম-সহ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কারণ কী? দেখা যাচ্ছে, উদ্বাস্তু-স্বার্থে আপাত-কল্যাণকর বিলটির বিরোধিতায় ইতিমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন অনেকেই। বিরোধীদের দাবি, এই বিল রাজ্যসভায় পাশ হলে এনআরসি লিস্টে বাদ পড়া উদ্বাস্তুরা তাঁদের অস্তিত্বের বৈধতা পেয়ে যাবেন। ফরেনার্স ট্রাইবুনালের মাধ্যমে শাস্তি পাওয়া ডিটেনশন ক্যাম্পে ‘বিদেশি’ অভিযোগে বন্দি মানুষরাও হয়তো সমস্যা সমাধানের একটা পথ খুঁজে পাবেন। তাঁদের মতে, এই বিলের ফলে অসমে নতুন করে বাংলাদেশি হিন্দু শরণার্থীর ঢল নামবে। আর তার জেরে নিজভূমে পরবাসী হয়ে যেতে পারেন অসমিয়ারা। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমর্থনে এই বিল পাশ করার প্রতিবাদে অসম গণ পরিষদ বিজেপির উপর থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আসু-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এই বিল পাশ করার প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। দাবি তুলেছে যে, এই বিল অসম চুক্তির পরিপন্থী। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের পরে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। ঠিক ১৯৭২ সালের আন্দোলনের ধাঁচে, নাগরিকত্ব বিল বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বয়কটেরও ডাক দিয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলি। নর্থ ইস্ট স্টুডেন্ট ইউনিয়নের (নেসো) ডাকা ১১ ঘণ্টার বন্‌ধে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যই কম-বেশি সাড়া দিয়েছে। আলফা (যারা ঘোষিত ভাবে তথাকথিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না) হুঙ্কার দিয়েছে যে, এই বিল আইনে পরিণত হলে আবার অসমে আগুন জ্বলবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ অসমের সাধারণ মানুষের মতামত ও আবেগকে নস্যাৎ করে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত অসমের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন, আর জানিয়েছেন যে শুধু অসম সরকারকে এই উদ্বাস্তুদের বোঝা বইতে হবে না, পুরো দেশই এ কাজে এগিয়ে আসবে।

ভোটব্যাঙ্ক মাথায় রেখে এই বিলকে অস্ত্র করে বিজেপি যখন নিজের কোর্টে বল নিতে চলেছে, পাশাপাশি একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে যে— মেঘালয়, মিজ়োরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা— এই রাজ্যগুলোতে এই বিলের বিরোধিতা তুঙ্গে উঠেছে। নেসো-র ডাকা বন্‌ধে সাড়া দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনজাতি সংগঠনগুলি প্রতিবাদে ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে, তার মধ্যে ত্রিপুরায় বিজেপি সরকারের জোটের শরিক আইপিএফটি-ও আছে। ত্রিপুরার জিরানিয়ায় পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছে ও পর পর সংঘর্ষের জেরে ৯৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সরকারকে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখতে হয়েছে। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা ঘোষণা করেছেন, এই বিল আইনে পরিণত হলে তিনিও বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করবেন। মণিপুর রাজ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রকে স্পষ্ট অনুরোধ জানানো হয়েছে, এই বিলের আওতা থেকে মণিপুরকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য। মেঘালয় ও মিজ়োরাম ইতিমধ্যে আবার এই বিলের বিরুদ্ধে প্রস্তাবও পাশ করে ফেলেছে বিধানসভায়। নাগাল্যান্ডেও বিল নিয়ে অশান্তি তুঙ্গে। শুধু অসম নয়, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্থানীয় রাজনীতির মূল সুরটি আসলে কোথাও বাঁধা আছে বহিরাগত বিরোধিতায়। তাই, সাতটি রাজ্যের মধ্যে যে রাজ্যগুলো ১৯৫১ সালে ছিলই না, অসমে নাগরিকত্ব নিয়ে দড়ি টানাটানি শুরু হওয়ার পর, আন্তঃরাজ্যের ভেতর সাময়িক যাতায়াতের সময়ও সেখানে চাওয়া হচ্ছে এনআরসি কাগজ।

কেন্দ্র ও অসমে যখন বিজেপি ক্ষমতাসীন, তখন অসম রাজ্যে এত বিরোধিতা ও আন্দোলন সত্ত্বেও ঠিক কী কারণে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করা হল, সেই প্রশ্নে আপাতত দ্বিধাবিভক্ত রাজ্যের বিভিন্ন শিবির। বিশেষ করে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে শুধু এই বিলের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে বিজেপির আসন পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকতে পারে, সেটা বুঝেও তারা পিছপা হয়নি। অনেকের মতে, রাজ্য স্তরের শেষ তিনটি ভোটের পরাজয় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাদের এই ফাটকা খেলতে অনুপ্রাণিত করেছে। সংশোধনী বিল ঘোষণায় সচেতন ভাবে একটিমাত্র সম্প্রদায়ের মানুষদের কথা উল্লেখ না করে, তাদের বাদ দিয়ে, হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে মজবুত করতে চাইছে বিজেপি, এটাই চলতি অনুমান। অথচ ‘তিন তালাক’কে কেন্দ্র করে কিছু দিন আগে এই দলই কিন্তু সংখ্যালঘুদের সমর্থন পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করেছিল। রাজনীতিতে আসলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। বিভিন্ন সরকারের আমলে নীতি নির্ধারণের জটিল প্রক্রিয়া, মতান্তর ও মনান্তরের ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ‘মিথ’ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।

এই অস্থির অবস্থায় অ-নাগরিক জনসাধারণের পক্ষে মূল সমস্যার বিষয় হল, অনেক জায়গাতেই স্থানীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধিতা ক্রমে উদ্বাস্তু-বিরোধিতার রূপ নিচ্ছে। এই বিল সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলে না। কিন্তু এই বিল ভারতীয় উদ্বাস্তুদের পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। নাগরিকত্ব না-ই বা হোক, সামান্য সামাজিক সুরক্ষাও যদি এই বিল তাঁদের দিতে পারে, তা-ই বা কম কী।

ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে

ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NRC Citizenship Bill Secularism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE