Advertisement
০৫ মে ২০২৪

উন্নয়ন লক্ষ্য হলে সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে রাখতে হবে

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যে, অসত্য ইতিহাসের প্রভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে থাকবে জাতিদাঙ্গা। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে বিরোধ বাধে, সে ধর্ম লইয়া; যদিচ আমরা মুখে সর্বদা বড়াই করিয়া থাকি, ধর্ম বিষয়ে হিন্দুর উদারতার তুলনা জগতে কোথাও নাই। কিন্তু বিশেষ শাস্ত্রমতের অনুশাসনের বিশেষ করিয়া যদি কেবল পশু হত্যা না করাকেই ধর্ম বলা যায় এবং সেইটে জোর করিয়া অন্য ধর্মমতের মানুষকেও মানাইতে চেষ্টা করা হয়, তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ কোনও কালেই মিটিতে পারেনা।

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৯
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে বিরোধ বাধে, সে ধর্ম লইয়া; যদিচ আমরা মুখে সর্বদা বড়াই করিয়া থাকি, ধর্ম বিষয়ে হিন্দুর উদারতার তুলনা জগতে কোথাও নাই। কিন্তু বিশেষ শাস্ত্রমতের অনুশাসনের বিশেষ করিয়া যদি কেবল পশু হত্যা না করাকেই ধর্ম বলা যায় এবং সেইটে জোর করিয়া অন্য ধর্মমতের মানুষকেও মানাইতে চেষ্টা করা হয়, তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ কোনও কালেই মিটিতে পারেনা। নিজে ধর্মের নামে পশু হত্যা করিব অথচ অন্য ধর্মের নামে পশু হত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনও নাম দেওয়া যায় না।

আজও ভারতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভাজনে গোহত্যা একটি বড় বিষয়। কলকাতায় নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু মহারাষ্ট্রে গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার কাশ্মীরে গোহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন হিন্দু রাজা হরি সিংহ। বাবরনামা থেকে জানা যায়, মোগল সাম্রাজ্যে প্রশাসনিক স্থায়িত্ব অর্জনের কথা তিনি বলেছিলেন, গোহত্যা যদি এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজকে আহত করে, তা হলে প্রশাসনিক স্থায়িত্ব অর্জনের জন্য এমন আইন পরিহার করাই ভাল।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় গোহত্যা নিবারণ নয়। কিন্তু গোটা পৃথিবী জুড়ে যে সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বিষয়টির সঠিক অনুশীলন প্রয়োজন। এ ব্যাপারে দু’পক্ষের চরমপন্থী মনোভাব যে বর্জনীয় সে ব্যাপারেও বার বার বলার সময় এসেছে। রন্তিদেব সেনগুপ্তের এক প্রবন্ধে পড়ছিলাম, ১৯২৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে নিজের বাসভবনে এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন আর্য সমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। আততায়ীর নাম আব্দুল রশিদ। রন্তিদেব লিখেছেন, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর হত্যাকাণ্ডকে কোনও ভাবে সমর্থন না করে বলছি, গাঁধীর হত্যাকাণ্ডের পিছনে যাঁরা সদাসর্বদা হিন্দু মৌলবাদী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ইত্যাদির ছায়া খুঁজে বেড়ান, তাঁরা কিন্তু স্বামী শ্রদ্ধানন্দের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বরাবরই সম্পূর্ণ নীরব থেকেছেন।

রবীন্দ্রনাথ নিজে কিন্তু চুপ করে থাকেননি। ব্যথিত কবি এক নিবন্ধে (স্বামী শ্রদ্ধানন্দ; প্রবাসী, মাঘ/১৩৩৩) লিখেছিলেন, ‘‘যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।’’ কাজেই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই দুর্বলতার কান্নার পক্ষেও ছিলেন না। বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগার ইসলামি মৌলবাদীদের হাতে নিহত হচ্ছেন। ব্যাঙ্ককের ব্রহ্মা মন্দিরের চত্বরে বিস্ফোরণ হচ্ছে। কত মানুষ সেখানে মারা যাচ্ছেন। আর এই জটিল পরিস্থিতিতে ইসলাম এবং মৌলবাদকে যেমন গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তেমনই হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুত্বের রাজনীতিকেও গুলিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। সম্প্রতি গোলাম আহমেদ মোর্তজার বই ‘সিরাজদুল্লার সত্য ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথ’ পড়ছিলাম। সেখানে লেখক দেখিয়েছেন যে সিরাজদৌল্লা ও মীরজাফর— এঁদের নিয়ে যে অনেক ভ্রান্ত ইতিহাস তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আপত্তি তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যে, অসত্য ইতিহাসের প্রভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে থাকবে জাতিদাঙ্গা।

কবি জসীমুদ্দিনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কেন যে মানুষ একের অপরাধের জন্য অপরকে মারেন। ও দেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের মারল। তাই এ দেশের হিন্দুরা ওখানকার মুসলমানদের মেরে তার প্রতিবাদ করবে, এই বর্বর মনোবৃত্তির হাত থেকে দেশ কী ভাবে উদ্ধার পাবে, বলতে পার?’ আসলে ইতিহাসও কোনও কালে প্রশ্ন ও বিচারের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। ইওরোপের ইতিহাসেও দেখা যায়, অনেক প্রচলিত ধারণা তিরস্কৃত হচ্ছে। আসলে ব্রিটিশরাই যে দাঙ্গা লাগিয়ে বিভেদনীতি রচনা করে গিয়েছে, এমন নয়। আসলে ভারতের অতীত পটভূমিতে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজিকা রেখা ছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সেই বিভাজনের সুযোগ নিয়ে প্রশাসনিক রণকৌশল তৈরি করে। আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। উগ্র হিন্দু আর উগ্র মুসলমানের মধ্যে আসলে কোনও ঝগড়া নেই। ভারতের উন্নয়ন যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিকাশ যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তা হলে বোধহয় সাম্প্রদায়িকতাকে আমাদের দূরে সরিয়ে রেখে এগোতে হবে।

দারাশুকো উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন। আকবর দীন-ই-ইলাহির জন্ম দিলেন। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে আজ আবু ধাবিতে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। আরব জাতির ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্কের কথা বলছেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদে যাচ্ছেন। গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে কোনও মসজিদে তিনি গিয়েছেন, আমার জানা নেই। এ-ও হল শাসনের দাবি। এ-ও হল সময়ের চাহিদা।

বিজেপি বনাম কংগ্রেস, তৃণমূল বনাম সিপিএম, হিন্দু বনাম মুসলমান— এই রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মেরুকরণের বাইরে আমরা কি এক মুহূর্তের জন্য ভারতীয়ত্বের সত্ত্বাকে নিয়ে ভাবতে পারি না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE