সব জীবন নয় সমান। ইরান, ইটালি, চিন-সহ পৃথিবীর অধিকাংশ করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে ভারতীয়দের বিশেষ বিমানে দেশে ফেরানো হল। উত্তরাখণ্ডে আটকে থাকা গুজরাতের তীর্থযাত্রী, কোটা শহরে অবরুদ্ধ ছাত্রদের স্ব-রাজ্যে ফেরাতে বাসের ব্যবস্থা হল। কিন্তু অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য হল না। অভিবাসী শ্রমিকরা সস্তা, উদ্বৃত্ত। খাবার তো দেওয়া হচ্ছে, আবার মজুরি চাই, বাড়ি ফিরতে চাই, এ সব কেন! অসহায় মানুষগুলি হেঁটে বা সাইকেলে চেপে গ্রামে, বাড়িতে ফিরতে চাইছেন। অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি সরকারের উদাসীনতা, পুলিশের অত্যাচার, মধ্যবিত্তের ধিক্কার আসলে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে বিগত তিন দশক ধরে চলতে থাকা প্রবণতার নির্মম রূপ।
বিশ্বায়নের তিন দশকে ভারতে এক দিকে যেমন আর্থিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে, অন্য দিকে বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। টমাস পিকেটি ও লুকাস চান্সেল এক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, ১৯২২ সালে ভারতের ধনীতম ১ শতাংশের আয় ছিল মোট আয়ের ১৩.১ শতাংশ, ১৯৩৯-এ যা বেড়ে হয় ২০.৭ শতাংশ। স্বাধীনতার পরে পরিকল্পনাভিত্তিক অর্থব্যবস্থার সময় ধনীতম ১ শতাংশের আয় দেশের মোট আয়ের অনুপাতে লাগাতার কমতে থাকে, যা ১৯৮২ সালে হয় মাত্র ৬.১ শতাংশ। দেশে যখন বিশ্বায়নের নীতি চালু হয় এবং আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ে, তখন অভূতপূর্ব গতিতে আর্থিক বৈষম্যও বাড়তে থাকে। ২০১৫-তে তা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে যায়, যেখানে ধনীতম ১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের ২১.৩ শতাংশ। ১৯৮২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের মোট আয়ের দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের অনুপাত ২৩.৬ শতাংশ থেকে কমে হয় ১৪.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, আর্থিক বৃদ্ধি যখন বেড়েছে, তার সুফল পেয়েছে দেশের ধনীতম অংশ, গরিবরা নয়।
এহেন বৈষম্য বর্তমান পৃথিবীতে বিরল। প্রায় সমস্ত দেশেই আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে, কিন্তু ভারতের মতো এত দ্রুত গতিতে বেড়েছে কম দেশেই। এই বৈষম্যের নৈতিক মান্যতা প্রমাণ করা সহজ নয়। তবু একটা গল্প খাড়া করা হয়েছে। বৈষম্যের কারণ নাকি কিছু মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি ও মেধা। সমাজে যদি তথাকথিত মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তির বৈষম্য থাকে, তবে আর্থিক বৈষম্য বাড়বে। অর্থাৎ, যারা পিছিয়ে পড়ল, দোষ তাদের। তারা পড়াশোনা জানে না, অলস, বোকা। আমরা যারা পড়াশোনা শিখেছি, তাদের আয় বেড়েছে। অতএব এ নিয়ে নিন্দামন্দ না করাই ভাল। এই মতাদর্শ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দারিদ্র, অনাহার, অসুস্থতাকে আমরা আক্রান্ত মানুষের দোষ হিসেবে দেখতে শিখেছি। অর্থনৈতিক, জাতিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমার অবস্থান যে আমাকে জন্মাবধি বাকি গরিব প্রান্তিক মানুষের থেকে এগিয়ে রেখেছে, সুবিধাভোগী জীবনে এই প্রশ্ন আমরা তুলি না। সমাজের, সরকারেরও যে দায় আছে, সে কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। তাই গরিবকে ভর্তুকি দেওয়া হলে ছি ছি করেছি আর কর্পোরেটদের কর ছাড় দেওয়া হলে তাকে আর্থিক প্রণোদনা বলে সমর্থন করেছি। বুঝে নিয়েছি, বিমানে কোভিড-আক্রান্ত দেশ থেকে ফিরে আসা আমাদের অধিকার, গরিব অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য নয়।