Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সব রোগের কি টিকা হয়
Coronavirus

ট্রায়ালের প্রথম ধাপ সফল, কিন্তু টিকা এখনও অনেক দূর

গবেষণার কোনও একটি ধাপে সাফল্যের সংবাদ মেলা আর সত্যিই কোনও কার্যকর প্রতিষেধক টিকা তৈরি করতে পারার মধ্যে বিস্তর ফারাক।

এই মুহূর্তে যদি আশার আলো কোথাও থাকে, তা আছে কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারে প্রাণপাত করা বিজ্ঞানীদের কাছে।

এই মুহূর্তে যদি আশার আলো কোথাও থাকে, তা আছে কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারে প্রাণপাত করা বিজ্ঞানীদের কাছে।

পর্ণালী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

এই অতিমারি বিধ্বস্ত সময়ে, তুমুল অনিশ্চয়তা, দ্বন্দ্ব আর ক্ষতির মাঝখানে আমরা আশাবাদী হব কোন মন্ত্রে? প্রতিষেধক টিকা, ওষুধ, প্লাজ়মাথেরাপি বা হার্ড ইমিউনিটি— কোনটা আমাদের জন্য সেই আশার আলো নিয়ে আসবে? না কি আমরা তত দিন অপেক্ষা করব, যত দিন না করোনাভাইরাস নিজে থেকেই দুর্বল হয়ে পড়বে, এক জন মানুষকেও সংক্রমিত করার শক্তি আর তার থাকবে না? এই মুহূর্তে যদি আশার আলো কোথাও থাকে, তা আছে কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারে প্রাণপাত করা বিজ্ঞানীদের কাছে। অতিমারির ধ্বংসলীলার মধ্যেই, টানা সাত মাসের অক্লান্ত চেষ্টায় তাঁরা সুখবর দিয়েছেন। দু’টি বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা দুনিয়ার সেরা দুই মেডিক্যাল জার্নালে তাঁদের কোভিড-১৯ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম পর্বের ফলাফল প্রকাশ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার এমআরএনএ ভ্যাকসিন, যার নাম এমআরএনএ১২৭৩, আর ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা-র এজ়েডডি১২২২ ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম পর্ব ইতিবাচক।

প্রতিষেধক টিকার দুনিয়ার পরশমণি হল হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা— এমন একটি অবস্থায় পৌঁছনো, যেখানে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের মধ্যেই নির্দিষ্ট সংক্রমণটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির করার জন্য কোনও জনগোষ্ঠীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ লোককে টিকা দেওয়া প্রয়োজন। সমাজে এমনও কিছু মানুষ তো থাকেন, যাঁদের সব ধরনের টিকা দেওয়া যায় না— সদ্যোজাত, কম বয়সের শিশু, নির্দিষ্ট কোনও অসুস্থতায় ভোগা মানুষ। গোষ্ঠী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলে এঁদের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে। তবে, দুনিয়া জুড়ে বিজ্ঞানী আর বিশেষজ্ঞেরা যখন কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধকের খোঁজে হন্যে হচ্ছেন, সেই সময় এক বার মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, কম সময়ের মধ্যে বাজারে টিকা পাওয়ার জন্য এই ব্যাকুলতা কখনও কখনও বড় বিপদও ডেকে আনতে পারে। ১৯৫৫ সালে পোলিয়োর প্রতিষেধক নিয়ে যে বিপত্তি হয়েছিল, তার কথা বলি।

সে বছর এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু’লক্ষেরও বেশি শিশুকে যে পোলিয়ো টিকা দেওয়া হয়েছিল, তাতে একটা মস্ত গোলমাল ছিল। যে পদ্ধতিতে এই টিকা তৈরি হয়েছিল, তাতে লাইভ ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতিটি কাজ করেনি। দিন কয়েকের মধ্যেই দুঃসংবাদ আসতে আরম্ভ করে— একের পর এক শিশু পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। দেশে প্রথম গণ পোলিয়ো টিকাকরণ অভিযান আরম্ভ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই সেটা থামিয়ে দিতে বাধ্য হয় মার্কিন প্রশাসন। পরবর্তী কালে তদন্তে জানা যায়, ক্যালিফর্নিয়ার কাটার ল্যাবরেটরিজ়-এ তৈরি এই টিকা গোটা দেশে ৪০,০০০ শিশুর মধ্যে পোলিয়োর সংক্রমণ ঘটিয়েছে, ২০০ শিশুর মধ্যে দেখা দিয়েছে পঙ্গুত্ব, এবং মারা গিয়েছে ১০টি শিশু।

আরও পড়ুন: চটজলদি গবেষণাপত্র ছাপানোর প্রবণতা মস্ত বিপদ ডাকছে

গত সোমবার, ২০ জুলাই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ঘোষণা করল, এখনও অবধি যতখানি পরীক্ষা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে তাদের টিকাটি নিরাপদ। টিকা আবিষ্কারের কাজে নিয়োজিত বিজ্ঞানীদলের নেতা সারা গিলবার্ট তাঁর তিন সন্তানকেই ট্রায়ালে এই টিকা দিয়েছেন। তারা সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। কাজেই টিকাটি নিরাপদ কি না, গিলবার্ট আপাতত তা নিয়ে খুব ভাবিত নন। তাঁর চিন্তা, অন্তিম পর্যায়ে টিকাটি যথেষ্ট কার্যকর হবে তো? ট্রায়ালের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ বলছে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, এবং যাঁদের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতাও তৈরি হচ্ছে। কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু গিলবার্টের মতে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। মডার্নাও তাদের টিকা এমআরএনএ১২৭৩-এর ট্রায়ালের প্রথম পর্বের ফলাফল কিছু দিন আগে প্রকাশ করেছে। সেই ফলও বেশ ইতিবাচক, তবে অক্সফোর্ডের ট্রায়ালের তুলনায় মডার্নাতে অনেক কম লোকের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল। এ দিকে, জার্মানির ফাইজ়ার আর চিনের কান্সিনো বায়োজেনিক্স-ও ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে পৌঁছে গিয়েছে। পাশাপাশি আরও অনেক সংস্থা এখন প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে। অর্থাৎ, যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে এখন সদ্য হিউম্যান ট্রায়ালের প্রথম পর্যায় আরম্ভ হয়েছে, তাদের গবেষণা শেষ হওয়ার আগেই বেশ কিছু সংস্থা কোভিড-১৯’এর টিকা বাজারে আনার ছাড়পত্র পেয়ে যাবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোলিয়ো টিকা বিপর্যয়ের পর ৬৫ বছর কেটে গিয়েছে। টিকা নিরাপদ এবং কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণার ফলাফল দেখে আশাবাদী হতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই বাজারে কোভিড-১৯’এর টিকা এসে যাবে, এ কথা বলার সময় এখনও কোনও মতেই হয়নি। প্রশ্ন করতেই পারেন, যেখানে গবেষণায় এত ইতিবাচক ফল মিলছে, অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা বলছে যে তারা খুব তাড়াতাড়ি বাজারে টিকা নিয়ে আসবে, সেখানে এত সংশয় প্রকাশ করছি কেন? একটা পাল্টা প্রশ্ন করি, এইচআইভি-র প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হল না কেন? সার্স বা মার্স-এর মতো ভাইরাসের ক্ষেত্রেও কোনও প্রতিষেধক এখনও নেই কেন? তার একটা সহজ উত্তর হল, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে টিকা পরীক্ষা করা হয় সুস্থ শরীরের স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর, কিন্তু সেই টিকা যখন বাজারে আসে, তখন সুস্থ এবং রোগাক্রান্ত, দু’ধরনের লোকই টিকা নেন। সেই সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় থাকে। সফল ভাবে কোনও টিকা আবিষ্কার করে তাকে বাজারে আনতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। এবং, তার পরও কোনও রোগকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে সময় লাগতে পারে আরও ২০ থেকে ৩০ বছর।

এখানে বুঝতেই হবে, গবেষণার কোনও একটি ধাপে সাফল্যের সংবাদ মেলা আর সত্যিই কোনও কার্যকর প্রতিষেধক টিকা তৈরি করতে পারার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সাফল্যের দ্বিতীয় ধাপটি অতিক্রম করতে বহু বহু বছরও লাগতে পারে। পোলিয়োর টিকার প্রসঙ্গে ফিরি এক বার। ১৯৫৫ সালে টিকাটি আবিষ্কার হওয়ার পর তার প্রথম প্রয়োগেই সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। তার পর, দুনিয়া জুড়ে পোলিয়োর টিকাকরণ হয়েছে। ২০১২ সালে সোমালিয়ায় শেষ পোলিয়ো আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ, টিকা আবিষ্কারের পর রোগটিকে নির্মূল করতে ৫৭ বছর লেগেছে।

এ বার ভাবুন, ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা পাওয়া যায় না কেন? তার কারণ, এই ভাইরাস অতি দ্রুত মিউটেট করে, অর্থাৎ নিজের চরিত্র পাল্টায়। তার প্রোটিনের কাঠামো প্রতি বছর এমন ভাবে পাল্টে যায় যে বিজ্ঞানীরা কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কারই করতে পারেননি। ধরুন, আজ যদি কেউ ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা আবিষ্কারও করেন, প্রতি বছর তার ডোজ় পাল্টাতে হবে অথবা প্রতি বছর নতুন টিকা আবিষ্কার করতে হবে। বিপুল খরচ, ফলে রোগীর খুব লাভ হবে না তাতে। কাজেই, আমরা যদি ভাবি যে কোভিড-১৯’এর টিকা বাজারে এলেই যুদ্ধজয় সম্ভব হবে, সম্ভবত সেটা ভিত্তিহীন আশাবাদ হবে, তার বেশি কিছু নয়।

টিকা আবিষ্কারের পর তা জোগাড়ের দৌড়ে ভারতের মতো দেশ মাঝেমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি বা ফ্রান্সের মতো দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। এইচ১এন১ মহামারির সময় বাজারে যত টিকা ছিল, তার বেশির ভাগই দখল করে নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যদিও অন্য দেশগুলিতেও টিকার প্রয়োজন ছিল বিপুল। তবে এই দফায় সুসংবাদ হল, ভারত ইতিমধ্যেই অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার সঙ্গে চুক্তি করেছে, তারা যদি টিকা আবিষ্কারে সফল হয়, তবে ২০২১ সালের মধ্যেই ভারতে ১০০ কোটি টিকা রফতানি করবে।

তার পরও অবশ্য প্রশ্ন থাকছে। আমদানি করা টিকার দাম কত টাকা হবে? সেই টিকা আমদানি করার পথে কোনও রাজনৈতিক বাধা তৈরি হবে কি? ভারতের বাজারে সেই টিকা ঠিক ভাবে জোগান দেওয়া যাবে? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, গরিব মানুষের কাছে যাতে সেই টিকা পৌঁছতে পারে, সেই ব্যবস্থা হবে কি? না কি আর পাঁচটা সুবিধার মতো এই টিকাও বড়লোকদের কুক্ষিগত হয়েই থেকে যাবে?

এপিডেমিয়োলজি বিভাগ, জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Vaccine Coronavirus in India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE