Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইস্কুল তথা রিয়াল এস্টেট

এই যে ‘আন্তর্জাতিক’ মুখোশ পরার ছটফটানি, এটা আগাগোড়া দৃশ্য-নির্ভর। স্বাচ্ছন্দ্যের দৃশ্য, সুযোগসুবিধের দৃশ্য, উঁচু প্রাচীর ও মজবুত গেটে ঘেরা নিরাপত্তা ও দূরত্বের দৃশ্য, পরিকাঠামো ও পরিষেবার দৃশ্য, আরামদায়ক ক্লাসরুমের দৃশ্য, সিসিটিভি ক্যামেরার নিশ্চয়তার দৃশ্য, বলা বাহুল্য, সবই বিশ্বমানের।

শ্রীদীপ
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

আবার সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার মরসুম। আমি যে শহরে থাকি, সেই দিল্লির মুখ ঢেকে গিয়েছে হরেক স্কুলের বিজ্ঞাপনে। কলকাতায় গেলে দেখি, ছবিটা খুব আলাদা নয়। কী লেখা থাকে সেই সব বিজ্ঞাপনে? একটু লক্ষ করলেই চোখে পড়বে, স্কুলগুলোর বিজ্ঞাপনে একটা শব্দ ঘুরেফিরে আসে ইদানীং‌— গ্লোবাল। বিশ্বমানের, আন্তর্জাতিক মানের, ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস’। এক অভিনব শ্রেণি-প্রকল্প মধ্যবিত্তকে প্রলুব্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, স্কুলের বিজ্ঞাপনের ফ্রেমগুলি তারই সাক্ষ্য দেয়। বেসরকারি স্কুলের বিজ্ঞাপন, অবশ্যই। সরকারি স্কুলের মান নিয়ে নতুন কোনও বিজ্ঞাপনের বোধ হয় কোনও অর্থ হয় না।

বেসরকারি স্কুলের দৃশ্য নির্মাণ ও তার চটক অন্যান্য পণ্যের মতোই। একটা ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করে বার বার গ্রাহককে নিজের উপস্থিতি মনে করিয়ে দেওয়া। অল্প কথায়, সহজ ভাষায় এবং ঝলমলে দৃশ্য দ্বারা বোঝাতে থাকা যে পণ্যটি কতই না অপরিহার্য। কেমন সব বিজ্ঞাপন চোখে পড়ছে, কয়েকটা উদাহরণ দিই। একটি শপিং মলের গোটা দেওয়াল জুড়ে প্রায় চল্লিশ ফুট লম্বা বিজ্ঞাপন। সেখানে একটি তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে গল্ফ খেলছে। ছবির পাশে লেখা: ‘প্রতিপালন’, ‘প্রশিক্ষণ’, ‘উৎকর্ষের’ শুরু এখান থেকেই। গল্ফ যখন শিক্ষাদানের চিহ্ন-রূপ ধারণ করে, তখন বোধ হয় তার আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ও শ্রেণি-উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও দ্বিমতের জায়গাই থাকে না। আর এক বিজ্ঞাপনে একটি শিশুর হাতে এরোপ্লেন। তার চাহনি আকাশমুখী। তার পাইলট-বাসনায় চেপে সে আজই পাড়ি দেবে দর্শককে সঙ্গে নিয়ে। দেখলাম, আর একটি প্রি-স্কুলের নাম ‘লিটল ইলিউশন্স’। আক্ষরিক অর্থে যার মানে দাঁড়ায়: ক্ষুদ্র ভ্রান্তিসকল! অনিচ্ছাকৃত ভুল? শব্দ-কৌতুক? না ‘ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ’? শিক্ষার নামে যে ভ্রান্তিবিলাস আমরা গড়েছি, সেখানে ভর্তি হওয়ার আমন্ত্রণ? অবশ্য একটু অন্য ভাবে দেখলে, লিখতে গেলে এ সব ছোট ছোট ভুল তো হয়েই থাকে। পরের বিজ্ঞাপনে শুধরে নেবে হয়তো, অজ্ঞতা দূর হলে পরে। এই যেমন, একটা স্কুলের নামের শেষ দু’টি শব্দ ছিল ‘মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট’। সংশোধনের পর এখন সেটা নির্দ্বিধায় ‘মেমোরিয়াল ইন্টারন্যাশনাল’। স্কুল বুঝেছে অভিভাবকদের প্রত্যাশায় স্বদেশি আর বিদেশির ফারাক। তাই লোকাল ঝেড়ে গ্লোবাল হয়েছে।

এই যে ‘আন্তর্জাতিক’ মুখোশ পরার ছটফটানি, এটা আগাগোড়া দৃশ্য-নির্ভর। স্বাচ্ছন্দ্যের দৃশ্য, সুযোগসুবিধের দৃশ্য, উঁচু প্রাচীর ও মজবুত গেটে ঘেরা নিরাপত্তা ও দূরত্বের দৃশ্য, পরিকাঠামো ও পরিষেবার দৃশ্য, আরামদায়ক ক্লাসরুমের দৃশ্য, সিসিটিভি ক্যামেরার নিশ্চয়তার দৃশ্য, বলা বাহুল্য, সবই বিশ্বমানের। ভেবে দেখলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর রিয়াল এস্টেটের ভাবমূর্তির মধ্যে আর বিশেষ তফাত নেই। দুটোই চড়া দামে মেলে বাজারে। দুটোতেই আজ বিনিয়োগ করলে কালকের ভবিষ্যৎ খানিকটা সুনিশ্চিত। দুটোই আপনাকে দেবে এক বিচ্ছিন্ন, সদা-সুরক্ষিত প্রাঙ্গণ— যেখানে একই শ্রেণির মানুষের আসা-যাওয়া, মেলামেশা। সবাই এখানে সুসজ্জিত। সবাই স্মার্ট। সবাই স্টেটাস-চিন্তায় মগ্ন। আসন অধিগ্রহণের একটা হাই-টেনশন ম্যাচ চলছে যেখানে হেরে যাওয়া ও পিছিয়ে পড়া প্রার্থীদের জন্য কোনও জায়গা নেই। আর এই গোটা খেলাটাই একটা দৃশ্যগত স্ট্রাটেজি। নানা ধরনের ইমেজ ঝোলানো আছে আন্তর্জাতিক মানের। ক্ষমতা থাকলে কিনে, পড়ে, লোক দেখিয়ে নিজের সামাজিক অবস্থান জাহির করো। আর মুরোদ না থাকলে তুমি টিম থেকে বাদ— তুমি ফ্রেমে থাকবে না— তুমি নিকৃষ্ট মানের, বিশ্বমানের নও।

এই দৃশ্যবার্তাগুলির মধ্যে এক ধরনের আধিপত্য ও অহমিকা কাজ করে। আর পাঁচটা পণ্যের মতো শিক্ষাও যখন শুধু সমৃদ্ধ শ্রেণির মানুষের সঙ্গেই কথা বলে, তখন তার সর্বজনীন দায়ভারের চরম অবমাননা হয়। সে দৃশ্য-ধারা সমাজের অন্যান্য স্তরকে অস্বীকার করে। সে দৃশ্য-দাপট জানান দেয় রাষ্ট্রের শিক্ষানীতির চরম ব্যর্থতার কথা। সে দৃশ্য-আদর্শ অধিকাংশ মানুষকে বঞ্চিত করে শিক্ষার সমান অধিকার থেকে। দৃশ্য দ্বারা গঠিত এক শ্রেণিভিত্তিক গণ্ডি গঠিত হয়, যেখানে প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞাপনের দৃশ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও মুক্তির ব্যাখান থাকলেও সেটা কেনার সামর্থ্য অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের নাগালে।

দৃশ্যগুলি শিক্ষা ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করে ও আহ্বান জানায় পয়সার জোর বাড়িয়ে দলে ঢুকতে। অর্থাৎ আঙুল তুলে বুঝিয়ে দেয় প্রবেশ-মূল্য— দেখলে হবে, খরচা আছে!

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Private School Infrastucture Kolkata Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE