—ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি দক্ষিণ দিনাজপুরকে কেন্দ্র করে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জেলাটিকে আবারও একবার প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। প্রথমটি হল, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তনে দক্ষিণ দিনাজপুরের বর্ষীয়াণ নাট্যকার হরিমাধব মুখোপাধ্যায়কে সাম্মানিক ডি-লিট উপাধি প্রদান। আর তার পরের দিন বালুরঘাট নাট্যমন্দিরে বালুরঘাট এর নান্দনিক আর কলকাতার ‘শিঞ্জন’ গোষ্ঠীর যৌথ প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের পরিবেশনা। উত্তরবঙ্গের ক্ষুদ্র জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক জগতে বরাবরই যথেষ্ট পরিচিতি আছে। এই দুই ঘটনা উল্লেখ করার মতো তারই দু’টি নমুনা মাত্র।
ঔপনিবেশ-শাসনের সময় জান-প্রাণ দিয়ে লড়াই করেছিলেন অধুনা-দক্ষিণ দিনাজপুর অঞ্চলের মানুষজন। এলাকাকে ব্রিটিশ মুক্ত করতে তাঁদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। সে সময় থেকেই এ অঞ্চলে শুরু হয়ে গিয়েছিল নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। কিছুটা ‘পোস্টকলোনিয়াল’ উদ্দেশ্যে হয়তো। বিশেষত নাট্যচর্চা। ১৯০৯ সালে স্থাপিত হয় ‘বালুরঘাট থিয়েট্রিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’। দু’বছর পরে ‘দ্য এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল ড্রামাটিক ক্লাব'। বর্তমানের বালুরঘাট নাট্যমন্দিরের মঞ্চটি ১৯০৯ সালে স্থাপিত হলেও এর অধুনা নাম রাখা হয় ১৯৪৭ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। যে শহরাঞ্চলে নাট্যকার মন্মথ রায় এসে পাকাপাকি ভাবে নাট্যচর্চা শুরু করবেন ১৯২৫ সাল নাগাদ, সে অঞ্চলে যে নাটকের বিশাল বিস্তৃতি থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। ১৯৫২ সালে গঠিত হয় ‘তরুণতীর্থ’ নাট্যদলের। ১৯৬৩-তে ‘ত্রিশূল নাট্য সংস্থা’ আর ১৯৬৯-তে দিনাজপুরের সুবিখ্যাত ‘ত্রিতীর্থ’-এর। ১৯৮২ সালে ‘বালুরঘাট নাট্যমন্দির’ ভেঙে জন্ম নেয় ‘নাট্যতীর্থ’। দক্ষিণ দিনাজপুরেরআর একটি নাট্যদল, ‘নাট্যকর্মী’র যাত্রা শুরু ১৯৯৩ সালে। তা থেকেই ২০০৬-এ ‘সমবেত নাট্যকর্মী’। দক্ষিণ দিনাজপুরের বোয়ালদাঁড় গ্রামে ১৯৪২ থেকে যে প্রতি বছর বাসন্তী পূজার সময় নাটকগুলি মঞ্চস্থ করা হত, সেই প্রথা এখনও সমান ভাবে জনপ্রিয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ‘দিনাজপুর রূপকথা’র মতো কিছু নাট্যদল দিনাজপুরেরর নাট্য-ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে যথেষ্ট নিপুণতার সঙ্গেই। প্রসূন, তুহিন, তনিমা, সুমন, সুমিত, শুভ্রশ্লেতা, প্রিয়ঙ্কা, দোয়েলদের মতো নাট্যশিল্পী, বাচিক শিল্পীদের হাতে দক্ষিণ দিনাজপুরের শিল্পসংস্কৃতির পরিমণ্ডল বিস্তৃতি লাভ করছে।
‘নাট্যমন্দির’-এর সদস্যেরা স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে সক্রিয় ভাবে ব্রিটিশ বিরোধিতায় অংশ নিয়েছিলেন। পুজোর সময় দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে নাট্যচর্চা হত এবং পরবর্তী সময়ে ‘ত্রিশূুল’ এবং ‘ত্রিতীর্থ’-এর মতো দলের বেশ কিছু প্রযোজনা আন্তর্জাতিক নাট্যজগতে পাকাপাকি ভাবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ‘পথের দাবী’ (নাট্যমন্দির), ‘মুক্তধারা’ (ত্রিশূল), ‘দেবীগর্জন’ (ত্রিতীর্থ), ‘জল’ (ত্রিতীর্থ ), ‘এক দুই’ (সমবেত নাট্যকর্মী) প্রভৃতি। এ ছাড়াও, ‘দিশারি নাট্যসংস্থা’ (পতিরাম), ‘আনন্দ-আশ্রম নাট্যসংস্থা’ (তপন), ‘ত্রিনয়ন নাট্যসংস্থা’ (গঙ্গারামপুর), ‘শুভম্’ (হরিরামপুর), ‘অগ্নিবীণা’ (বংশীহারি) বিভিন্ন সময় দক্ষিণ দিনাজপুর অঞ্চলের নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক পরিসরকে সমৃদ্ধ করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে চলেছে বিভিন্ন নৃত্য-সংস্থাগুলিও। যেমন, ‘ছন্দম্’, ‘আবির’, ‘ঋষিগন্ধা’, বা ‘হৃদ্কমল’— যারা মাঝেমধ্যেই নানা নৃত্যনাট্য সুচারু ভাবে পরিবেশন করে। ‘শ্যামা’ সে রকমই একটি প্রযোজনা। এই জেলার বেশ কিছু নৃত্যশিল্পী দেশবিদেশে আমন্ত্রিত হয়েছেন শিল্পকলা প্রদর্শনের জন্য। ইতিমধ্যে জেলা তথ্যসংস্কৃতি দফতরের উদ্যোগে আর ‘নান্দনিক’-এর মতো নৃত্যদলগুলির প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নৃত্যশিল্পীরা দক্ষিণ দিনাজপুরের মতো ছোট জেলাটিতে আসতে শুরু করেছেন। আশা করা যায়, সর্বভারতীয়-স্তরে বিশেষ পরিচিতি লাভ করবে এই জেলা। এর পাশাপাশি জেলার বাচিক শিল্পকেন্দ্রগুলি। ‘অর্পণ’ বা ‘নৈবেদ্য’র মতো সংস্থাগুলি নবীনদের প্রশিক্ষিত করে তুলছে।
তবে, পূর্বতন দিনাজপুর, তারপর পশ্চিম দিনাজপুর এবং ১৯৯২ সালে জেলাভাগের পর দক্ষিণ দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক জগৎ শুধু নাট্যচর্চায় সীমাবদ্ধ নয়। লিটল ম্যাগাজিনের নিয়মিত প্রকাশও দক্ষিণ দিনাজপুরকে আলাদা পরিচয় দান করেছে। ‘আত্রেয়ী’ নামক ক্ষুদ্র-পত্রিকাটি চলেছিল ১৯৫৮ পর্যন্ত যা পশ্চিম দিনাজপুরের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন। এর পর পঞ্চাশের দশকেই প্রকাশ পেতে থাকে ‘আলোড়ন’, ‘নবারুণ’, ও ‘কিশোর ভারতী’। ১৯৬৬ সাল থেকে সুধীর করন আর অজিতেশ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে নিয়মিত ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে ‘মধুপর্ণী’। ১৯৬৮-এর পরে আসে ‘প্রলয়’, ‘সঞ্চারিণী’, ‘ত্রিনয়নী’ এবং ১৯৭৭ সালে ‘স্পন্দন’, ১৯৮১-তে ‘সূর্যবীজ’। আধুনিক পত্রপত্রিকার মধ্যে ‘দক্ষিণ দিনাজপুর বার্তা’, ‘বালুরঘাট বার্তা’, ‘সংবাদ দধীচি’ এবং ‘প্রত্যুষ’ যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছে।
দেশভাগের যন্ত্রণাকে বুকে করে যে সব মানুষ ওপার-বাংলা থেকে এপার-বাংলায় এসে বসতি তৈরি করেছিলেন অধুনা দক্ষিণ দিনাজপুর অঞ্চলে, তাঁদের কাছে নাট্যচর্চা ছাড়াও সঙ্গীতচর্চাও ছিল দুঃখ ভোলার অন্যতম মাধ্যম। এখন বেসরকারি টিভি’র প্রতিযোগিতার দৌলতে মানুষ চিনে গিয়েছেন এই জেলাকে। মেখলা-রাজর্ষীর মতো নাম আজ মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। এই নামগুলির আড়ালে কিন্তু ঢাকা পড়ে যায়নি কিছু জ্যোতিষ্কের নাম, যাঁরা দেশভাগের সময় থেকে তিলে তিলে দিনাজপুর অঞ্চলের সাঙ্গীতিক পরিচয় গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে প্রয়াত, অনেকে প্রবীণ। থেকে গিয়েছে তাঁদের রেকর্ড-করা কণ্ঠস্বর আর স্মৃতি— শান্তিগোপাল রায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রণব চক্রবর্তী, প্রবীর খাঁ, মালবিকা খাঁ প্রমুখ।
এ জেলায় রয়েছে অঙ্কনচর্চা, কাব্যচর্চা, কাব্যরচনা সাহিত্যচর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস। মন্মথ রায় থেকে শুরু করে অভিজিৎ সেন কিংবা হরিমাধব মুখোপাধ্যায়। প্রতি বছরই প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ, ছোটগল্পের সম্ভার। এ ছাড়া রয়েছে ‘দক্ষিণ দিনাজপুর ফিল্ম অ্যান্ড ফোটোগ্রাফি ক্লাব’ বা ‘হ্যাশট্যাগ দক্ষিণ দিনাজপুর’-এর মতো বেশ কিছু সংস্থা, যারা ছবি বানানোর কাজে হাত দিয়েছে। স্বল্পদৈর্ঘের ছবির উৎসব আয়োজিত হচ্ছে প্রতি বছরই। তাই, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে দক্ষিণ দিনাজপুরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তা বললে অত্যুক্তি করা হয় না বোধ হয়।
(লেখক রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy