Advertisement
১১ মে ২০২৪

মানবিকতার ডাক

তাহা হইলে কি ইহাই বিশ্বাস করিতে হইবে যে যুক্তিবোধ তো বটেই, মানবিকতার অনুভূতিও সাধারণ্য হইতে অন্তর্হিত? মানুষ সহ-মানুষকে শুধুমাত্র ধর্ম ও একদেশদর্শিতার নিরিখেই বিচার করিবে?

কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি আক্রমণে ৪৯ জন সেনা নিহত হইবার পরে কাশ্মীরিদের ওপর দেশের সর্বত্র আক্রমণ হচ্ছে।—ছবি রয়টার্স।

কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি আক্রমণে ৪৯ জন সেনা নিহত হইবার পরে কাশ্মীরিদের ওপর দেশের সর্বত্র আক্রমণ হচ্ছে।—ছবি রয়টার্স।

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

আজি হইতে দুই হাজার চারিশত বৎসর পূর্বে ‘গণতান্ত্রিক মানুষ’-এর চরিত্র সম্বন্ধে সতর্ক করিয়া গ্রিক দার্শনিক প্লেটো লিখিয়াছিলেন, সে মিথ্যা ও আড়ম্বরপূর্ণ বাক্য পাথেয় করিবে, দুর্বিনয়কে সুশিক্ষা বলিবে, স্বেচ্ছাচারকে স্বাধীনতা ও সংযমকে কাপুরুষতা আখ্যা দিবে। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি আক্রমণে ৪৯ জন সেনা নিহত হইবার পরে দিকে দিকে ক্রোধতপ্ত সাধারণ মানুষের আচরণ দেখিয়া দার্শনিক-বাক্যের যাথার্থ্য বুঝা যাইতেছে। সোশ্যাল মিডিয়া রণহুঙ্কারে কম্প্র, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়া যেন সময়ের অপেক্ষামাত্র। যুক্তি ও বিবেক আশ্রয়ে যাঁহারা যুদ্ধ তথা হিংসার বিরোধিতা করিয়া ফেসবুকে লিখিয়াছিলেন, তাঁহাদের উপর নামিয়া আসিয়াছে আঘাত: ইহারা দেশদ্রোহী। কাশ্মীরি সহনাগরিকদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন লইয়া সরব হইয়াছিলেন যাঁহারা, তাঁহাদের শুনিতে হইয়াছে, অত দরদ উথলাইলে কাশ্মীর বা পাকিস্তান চলিয়া যান। সঙ্গে জুটিয়াছে অকথ্য অশ্রাব্য কটূক্তি, চরিত্রহনন। ফেসবুকের লেখা দেখিয়া উন্মত্ত জনতা কোথাও চড়াও হইয়াছে শান্তিকামী মানুষটির গৃহে; কান ধরিয়া, ‘ভারতমাতা কি জয়’ স্লোগান দিয়া আতঙ্কিত নাগরিকটির পরিত্রাণ মিলিয়াছে। দুই দশকেরও বেশি সময় কলিকাতাই যাঁহার ঠিকানা, সেই কাশ্মীরি চিকিৎসক স্তম্ভিত হইয়া দেখিতেছেন, উদগ্র দেশপ্রেমীর দল তাঁহার গর্দান চাহিতেছে। নদিয়ায় কাশ্মীরি শালবিক্রেতা আক্রান্ত, রক্তাক্ত হইয়া পথে লুটাইয়া পড়িতেছেন। এত দিন জানা ছিল, একাকী মানুষ দুর্বল বলিয়া তাহাকে আঘাত করা সহজ। কলিকাতার রাজপথে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে সমষ্টির উপর অপ্রত্যাশিত আক্রমণ সেই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করিয়াছে।

তাহা হইলে কি ইহাই বিশ্বাস করিতে হইবে যে যুক্তিবোধ তো বটেই, মানবিকতার অনুভূতিও সাধারণ্য হইতে অন্তর্হিত? মানুষ সহ-মানুষকে শুধুমাত্র ধর্ম ও একদেশদর্শিতার নিরিখেই বিচার করিবে? সৌভাগ্যের কথা, আক্রান্তের সহায় হইয়া পাশে দাঁড়াইয়াছেন সাধারণ মানুষই। সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসিত কটূক্তিতে মত্ত স্বরের পাশেই শুনা যাইতেছে উদাত্ত আহ্বান: কাশ্মীরি কি অ-কাশ্মীরি কেহ আমার পাড়ায়, শহরে বা রাজ্যে নিরাপত্তার অভাব বোধ করিতেছেন বলিয়া মনে করিলে আমার গৃহে আসুন, দ্বার উন্মুক্ত। নদিয়ায় সন্ত্রস্ত শালবিক্রেতা বা মহানগরের কাশ্মীরি চিকিৎসককে বন্ধুতায় ঘিরিয়া রাখিয়াছেন যে প্রতিবেশীগণ, তাঁহারাও কেহ প্রভাবশালী কেষ্টবিষ্টু নহেন, সাধারণ মানুষ। দেশের স্থানে স্থানে কাশ্মীরিরা আক্রান্ত হইতেছেন, এ হেন পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের জনসাধারণও প্রতিশোধপরায়ণ হইয়া কাশ্মীরে কর্মসূত্রে যাওয়া অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের উপর ঝাল মিটাইতে পারিতেন। তাহা হয় নাই, উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, হরিয়ানার অসংখ্য সাধারণ মানুষকে কাশ্মীরি নাগরিকেরা অভয় দিয়া বলিতেছেন, তোমরা এই রাজ্যের অতিথি, তোমাদের প্রতি কোনও দ্বেষ করিব না। দুই হাজারের উপর কাশ্মীরি যুবক সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উপস্থিত হইয়াছে। অম্বালা, দেহরাদূনে শিখ ধর্মাবলম্বী বহু মানুষ রাতারাতি স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী গড়িয়া বাসে বা ট্যাক্সিতে শঙ্কিত কাশ্মীরি মানুষদের গৃহে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করিয়াছেন, কাশ্মীরি ছাত্রাবাস পাহারা দিয়াছেন। কৃতজ্ঞ কাশ্মীর তাঁহাদের হোটেল ভাড়া, চিকিৎসকের পারিশ্রমিক, শিখ শিশুদের জন্য ইংরেজি শিখিবার কোর্স ফি মকুব করিয়া বলিতেছে, বন্ধুতার প্রতিদান স্বরূপ এইটুকু মাত্র করিতে পারিয়া আমরা কৃতার্থ। কলিকাতায় যুদ্ধবিরোধী মিছিল আক্রান্ত হইলেও তাহাতে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের উপস্থিতিই প্রমাণ, গণতন্ত্র এখনও মানবিকতারহিত হয় নাই। অদ্ভুত অন্ধকারের মধ্যেও তাহা হইলে আশার আলো রহিয়াছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Violence Pulwama Terror Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE