Advertisement
E-Paper

প্রকৃতি ভুলে কি উন্নয়ন হয়

তুতিকোরিনের ঘটনার চরিত্র ও মাত্রা পৃথক। কিন্তু বিপর্যয়ের সূত্র সেই দূষণ। স্টারলাইট কারখানা তামা উৎপাদন করত ১৯৮০-র দশক থেকে।

শৌভনিক রায়

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৮ ০০:৩৪
ক্ষুব্ধ: তুতিকোরিনে স্টারলাইট কারখানার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। আগুন লাগানো হয় একাধিক গাড়িতে। মে, ২০১৮। ছবি: পিটিআই

ক্ষুব্ধ: তুতিকোরিনে স্টারলাইট কারখানার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। আগুন লাগানো হয় একাধিক গাড়িতে। মে, ২০১৮। ছবি: পিটিআই

তামিলনা়ড়ুর তুতিকোরিনে স্টারলাইট কারখানার মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আবার সামনে চলে এল উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক বিকাশ ও পরিবেশের চিরাচরিত দ্বন্দ্ব। মনে পড়ছে ১৯৮৪-র ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ। প্রায় ৪,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন ইউনিয়ন কার্বাইড পরিচালিত কারখানায় গ্যাস দুর্ঘটনায়। সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়েছিল সুস্থ জীবন ও জীবিকা। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন জটিল ব্যাধিতে। এখনও বহু পরিবার বহন করছে সেই দূষণের অভিশপ্ত উত্তরাধিকার।

তুতিকোরিনের ঘটনার চরিত্র ও মাত্রা পৃথক। কিন্তু বিপর্যয়ের সূত্র সেই দূষণ। স্টারলাইট কারখানা তামা উৎপাদন করত ১৯৮০-র দশক থেকে। কিন্তু বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কোনও সুষ্ঠু ব্যবস্থা ছিল না। বিপজ্জনক ভাবে দূষিত হচ্ছিল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাতাস ও জলসম্পদ। এর শিকার হচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্ষোভ দানা বাঁধছিল অনেক দিন ধরে। পূর্বে এই অভিযোগে একাধিক বার বন্ধ হয়েছিল কারখানা। তার পরেও কোনও পরিবর্তন হয়নি। চরম ঔদাসীন্যের পরিচয় দিয়েছে স্টারলাইট কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য প্রশাসন। প্রতিবাদে ২০,০০০ মানুষের মিছিল সংগঠিত হয় ২২ মে। বেপরোয়া গুলি চালায় পুলিশ। প্রাণ হারান ১৫ জন বিক্ষোভকারী। পরবর্তী দিনগুলিতে আন্দোলন আরও তীব্র রূপ নেওয়ায় কারখানা বন্ধের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয় তামিলনাড়ু সরকার। পরিবেশ ও উন্নয়নের দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র।

দ্বন্দ্বের বিষয়টি একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। এই আলোচনা বিশেষ করে প্রয়োজন ১৩৫ কোটি মানুষের ভারতে, কারণ এই দেশে উৎপাদনশিল্পে কর্মসংস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্য দিকে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নটিও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ৩০ কোটি মানুষের জীবনজীবিকা বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এঁদের বেশির ভাগই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা প্রান্তিক মানুষ। এ-ও জানা যাচ্ছে যে, স্টারলাইট কারখানা বন্ধ হওয়ায় কাজ হারিয়েছেন তিন হাজার মানুষ। উন্নয়নশীল দেশের রূঢ় বাস্তব— এক দিকে বেকারত্ব কমাতে স্টারলাইটের মতো কারখানায় বৃহৎ কর্মসংস্থানের আশ্বাস, আর অন্য দিকে পরিবেশসংক্রান্ত বিধিনিষেধ পালনে চূড়ান্ত অনীহা। জটিল সমস্যা। সুষ্ঠু সমাধান না হলে এ রকম বিপর্যয় মাঝে মধ্যেই অবশ্যম্ভাবী।

বিশ্বায়নের যুগে কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার সেই দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির মুখ্য সূচক। বৃহৎ জনসংখ্যার দেশগুলির মধ্যে এই নিরিখে ভারতের স্থান প্রথম। তার পর চিন। ভারতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার বর্তমানে ৭.৪ শতাংশ। সরকার, বিনিয়োগকারী মহল, সংবাদমাধ্যম ও দেশবাসী গৌরবান্বিত— দোর্দণ্ডপ্রতাপ চিন আমাদের পিছনে। প্রগতির রথ দ্রুত ধাবমান। আড়ালে চলে যাচ্ছে সব দুর্বলতা। সকলের অলক্ষ্যে পরিবেশ উন্নয়নের সূচকে আমাদের দুরবস্থা। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে সুইৎজ়ারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে প্রকাশিত বিশ্ব পরিবেশ সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১৭৭তম। ২০১৬ সালের থেকেও ৩৬টি স্থান পিছনে। তালিকার সর্বনিম্ন পাঁচটি দেশ— বাংলাদেশ, নেপাল, কঙ্গো ও বুরুন্ডির সঙ্গে ভারত একই বন্ধনীতে।

পরিবেশ সূচকে ক্রমাবনতির মূল কারণ দেশে বায়ুদূষণের প্রাবল্য ও পরিবেশসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধানে (ময়লা জল নিষ্কাষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) চূড়ান্ত অব্যবস্থা। বোঝাই যাচ্ছে, স্বচ্ছ ভারত মিশন চালু হওয়ার চার বছর পরেও অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি। গত এক দশকে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ২০১৭ সালে দেশে এর প্রভাবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬ লক্ষের বেশি। দিল্লি শীতের দু’মাস দুনিয়ার বায়ুদূষণের রাজধানী হিসেবে পরিচিত।

আর্থিক সমৃদ্ধি আর পরিবেশের সূচকের বৈপরীত্য স্পষ্ট। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে চোখধাঁধানো সমৃদ্ধির মূল্য কি তা হলে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং তার ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক মানুষ?

অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক প্রগতি ও পরিবেশ সূচকের বৈপরীত্যের মূলে আছে ভূপ্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক বৈচিত্র সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের সুস্পষ্ট ধারণার অভাব, পশ্চিমি উন্নয়ন মডেলের অন্ধ অনুকরণ, দুর্বল পরিচালনা ব্যবস্থা এবং উপযুক্ত প্রযুক্তির অপ্রতুলতা। প্রশ্ন হল, আর্থিক বিকাশে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভূমিকা কী? অভ্যন্তরীণ জাতীয় উৎপাদনের হিসেবে উন্নয়নের জন্য পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির কি কোনও মূল্যায়ন করা হয়? কয়েকটি মাত্র স্ক্যান্ডেনেভিয়ান ও ইউরোপীয় দেশ বাদ দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর উত্তর, ‘না’। চিন ২০০৪ সালে শুরু করেছিল, কিন্তু তার পর বেশি অগ্রসর হয়নি।

কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব। দ্বিতীয়ত, পরিবেশের ওপর উন্নয়নের প্রভাবের মূল্যায়ন বা অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিফলনে রাজনৈতিক ঝুঁকি বড় বেশি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা কোনও সরকার এই ঝুঁকির রাস্তায় হাঁটতে সচরাচর রাজি হয় না। বিনিয়োগকারী মহল, সংবাদমাধ্যম, সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে নেমে গেলে। বিচিত্র পরিস্থিতি। আপাতদৃষ্টিতে সমাজ পরিবেশের বিষয়ে সংবেদনশীল। সেমিনার, সভাসমিতিতে পরিবেশ নিয়ে আলোচনা। প্রতি বছর মহাসমারোহে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্‌যাপন। কিন্তু আর্থিক বিকাশে পরিবেশের লাভ-ক্ষতির মূল্যায়ন এখনও সুদূর কল্পনা। যেন এই আলোচনার অর্থ সমৃদ্ধির উল্টো পথে হাঁটা।

২০০৯ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকারের আমলে খ্যাতনামা পরিবেশ অর্থনীতিবিদ পার্থ দাশগুপ্তর তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী পরিবেশ সম্বন্ধিত জাতীয় উৎপাদন (গ্রিন জিডিপি) নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। শোনা যায় কমিটি ২০১৩ সালে সুপারিশ জমা দিয়েছিল। আজও দিনের আলো দেখেনি সেই প্রস্তাবগুচ্ছ। প্রশাসনিক স্তরে কোনও আলোচনা হয়েছে বলেও জানা নেই। অপর দিকে, ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের সমীক্ষা জানাচ্ছে, বায়ুদূষণের ফলে আমাদের দেশে ক্ষতির পরিমাণ জাতীয় উৎপাদনের ৮.৫ শতাংশ। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে উর্বরতা কমেছে ৩২ শতাংশ কৃষিজমির। এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছে কৃষি উৎপাদনে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে কৃষকদের জীবিকা। জীববৈচিত্রপ্রধান রাজ্য হিমাচলপ্রদেশে গত দু’দশকে ১২,০০০ হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সিমেন্ট কারখানা, রাস্তা সম্প্রসারণ ও পর্যটন প্রকল্পে।

মূল ধারার উন্নয়নী ভাবনা যে কোনও মূল্যে পুঁজির আবাহনে ব্যস্ত। যেন প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়নের মডেলই বিকাশের একমাত্র পন্থা।

সামনে লোকসভা ও বেশ কয়েকটি বিধানসভার নির্বাচন। পরিবেশ নিয়ে বিশ্লেষণী আলোচনা বড়ই ঝুঁকিসাপেক্ষ। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহারেও উৎপাদনের হার বৃদ্ধিই মূল বিচার্য বিষয়। নির্বাচনী রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করে উন্নয়ন ও পরিবেশের আলোচনা অসম্ভব। একই ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন, জীববৈচিত্র, প্রাকৃতিক সম্পদ ও তার ওপর নির্ভরশীল বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবিকা উপেক্ষা করে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা অনৈতিক। আর্থিক প্রগতি ও পরিবেশ সূচকের সামঞ্জস্য তাই জরুরি।

শুরু হোক বিতর্ক— উন্নয়নের অভীষ্ট নিয়ে। বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি হলে কী লাভ? হার খানিক কমলে সত্যিই কি ক্ষতি? ভারতের মতো জনবহুল ও বহু বৈচিত্রের দেশে পরিবেশের ধারণ ক্ষমতার সঙ্গে আর্থিক বিকাশের কী সম্পর্ক? তৈরি হোক অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নের অগ্রাধিকার— বাস্তুতন্ত্র-কেন্দ্রিক পরিকল্পনা। তার উদ্দেশ্য হোক সর্বজনীন কল্যাণ— মানুষের জীবনজীবিকার মানোন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিবেচনাপ্রসূত ব্যবহার ও সংরক্ষণ।

১৩৫ কোটি ভারতীয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে উন্নয়নের বিকল্প ভাষ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

আইআইইএসটি (শিবপুর)-এ স্কুল অব ইকোলজি অ্যান্ড হিউম্যান সেটল্‌মেন্টস-এর অধিকর্তা

Developing world growth environment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy