ঘৃণা বস্তুটি প্রবহমাণ, এবং তাহার গতি সততই নিম্নমুখী। গৌতম দেব সম্প্রতি যে নদীতে অবগাহন করিয়া বিস্তর নিন্দামন্দ কুড়াইতেছেন, তাহার উৎসমুখ বহু দূরে। শ্রেণিশত্রুর প্রতি ‘পবিত্র ঘৃণা’ পোষণ করার বামপন্থী সংস্কৃতিতে। অস্বীকার করা চলিবে না, অন্তত তাত্ত্বিক ভাবে সেই ঘৃণা ব্যক্তির প্রতি নহে, ব্যক্তি যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন, তাহার প্রতি— কিন্তু বিদ্বেষ আর কবে সেই সূক্ষ্ম বিচারের ধার ধারিয়াছে? ফলে, ব্যক্তি-ঘৃণা ক্রমে বাম রাজনীতির ঐতিহ্যে পরিণত হইয়াছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করিবার সময় তাঁহার রাজনীতিকে ভুলিয়া ব্যক্তিই লক্ষ্য হইয়াছে। পার্টি যখন ভাঙে নাই, তখনও এই অ-সভ্যতা ছিল, ভাঙনের পরেও ধারাটি অব্যাহত। গৌতম দেব উদাহরণ দিতে পারেন। সুভাষচন্দ্র বসুর নামে কটূক্তি আর অতুল্য ঘোষের শারীরিক ত্রুটি তুলিয়া ব্যঙ্গ করিবার মধ্যে সময়ের ব্যবধান কয়েক দশকের, মানসিকতার ব্যবধান নাই। বিমান বসু হইতে বিনয় কোঙার, আনিসুর রহমান হইতে অনিল বসু— প্রত্যেকেই দলীয় সংস্কৃতির সেই ধারাটি বজায় রাখিয়া চলিয়াছেন। এমনকী জ্যোতি বসুও যখন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্যগুলি করিতেন, তাহার মধ্যেও রাজনীতি অপেক্ষা ঘৃণার অনুপাতই বেশি থাকিত। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট যদি আজ গৌতম দেবের অশালীন উক্তির নিন্দা করে, তবে নিন্দাটি ইতিহাসের ক্রম মানিয়া করাই ভাল। ঐতিহাসিক ভুল তাঁহাদের অনেক আছে, সংশোধনের চেষ্টা সেই তুলনায় নগণ্য।
ব্যক্তি-আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে থাকা মানুষটি যদি লিঙ্গপরিচয়ে নারী হন, তবে আক্রমণের মাত্রা আরও এক ধাপ চড়ে। তখন মনের অতলে থাকা যাবতীয় নারীবিদ্বেষ নির্দ্বিধায় প্রকট করিয়া ফেলা চলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু বার সেই আক্রমণের শিকার হইয়াছেন। এই নারীবিদ্বেষও কি কমিউনিস্ট পার্টিরই ঐতিহ্য নহে? দলের অভ্যন্তরে পিতৃতন্ত্রের নিগড় কতখানি মজবুত, বাম আন্দোলনের সহিত জড়িত বহু মহিলা কর্মীর স্মৃতিকথায় তাহা বহু বার প্রকাশ পাইয়াছে। নারীকে সম-মানুষের মর্যাদা দিতে পিতৃতন্ত্রের যে আপত্তি, বামপন্থী দলগুলি অবিচলিত নিষ্ঠায় তাহাকে মান্য করিয়াছে। অনুমান করা চলে, কোনও বিরোধী নেত্রীর মোকাবিলা করিতে হইলে বাম নেতারা তাঁহার ‘নারী’ পরিচয়টিকে অতিক্রম করিয়া আর কিছু দেখিতে পান না। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ন্যায় প্রবল নেত্রী হইলেও নহে। তিনি ইন্দিরা গাঁধী হইলেও নহে। এই কদর্যতায় গৌতম দেব প্রথম নহেন। আশঙ্কা হয়, তিনি শেষও নহেন।
এই ঘৃণার রাজনীতি যদি শুধু বামপন্থী দলগুলির চৌহদ্দিতে আবদ্ধ থাকিত, তবুও এই ক্ষীণ আলোকরেখার সন্ধান হয়তো মিলিত। দলগুলির সত্তা বলিতেছে, তাহাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নাই। অতএব, কেহ আশা করিতে পারিতেন, হয়তো বামপন্থী দলগুলির সহিত এই অসভ্যতার সংস্কৃতিও কালের গর্ভে মিলাইয়া যাইবে। কিন্তু তাহা হইবার নহে। সিপিআইএম-এর পাঠশালায় আরও অনেক কিছুর ন্যায় এই অসভ্যতাটিও তৃণমূল কংগ্রেস অক্ষরে অক্ষরে শিখিয়াছে। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস পাল বা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ন্যায় নেতারা ভুঁইফোঁড় নহেন, তাঁহারা সিপিআইএম-এর রাজনৈতিক (অপ)সংস্কৃতির সন্তান। ফলে, বামপন্থীরা থাকুন আর না-ই থাকুন, ব্যক্তি-আক্রমণের অসহ অভ্যাসটির বিনাশ নাই। এই সংস্কৃতি বদলাইতে পারে শুধু নাগরিক সমাজ। যদি রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষেই এ হেন অসভ্যতার প্রতিবাদ হয়, যদি সমাজ জানাইয়া দেয়, কোনও অবস্থাতেই এই বর্বরতা সহ্য করা হইবে না, তবে নেতারা বদলাইতে পারেন। দুর্ভাগ্য, সমাজও সেই আশ্বাস দিতে ব্যর্থ। রাজনৈতিক রঙের ঊর্ধ্বে আর কিছু তাহার চোখে পড়ে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy