Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রেখেছ পুরুষ করে

‘নারীবাদী’ শব্দটা শুনলেই অনেক নারী এবং পুরুষ কয়েক যোজন ছিটকে যান। সেই ছুটে পালানোয় কৌতুক থাকে। উপেক্ষা থাকে।

অন্বেষা দত্ত
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

এলাকে আমি খুব ভালবাসি। ওর জন্য চিন্তা হয়। কারণ বাবা, ছেলে, স্বামী এবং নাগরিক হিসেবে রোজ দেখতে পাই, মহিলারা কী রকম বাধার মুখোমুখি হন। এটা ২০১৭। তবুও কানাডা বা গোটা বিশ্ব জুড়ে এখনও হিংসা, বৈষম্য, ছকবাঁধা সেই দেওয়ালগুলো মহিলাদের আটকে রাখে। এটা ভাবলেই আমার পাগল-পাগল লাগে। আমার তুখড় বুদ্ধির মেয়েটা এমন একটা দুনিয়ায় বড় হবে, যেখানে ওর কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে না, কেউ ওকে তুড়িতে উড়িয়ে দেবে, শুধু ওর লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্য...’ লিখছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রু়ডো। আর তাঁর লেখার বিষয়,
‘কেন আমার বাচ্চাদের আমি নারীবাদী হিসেবে বড় করতে চাই’ (‘হোয়াই আই অ্যাম রেজিং মাই কিডস টু বি ফেমিনিস্টস’)।

মাসখানেক আগেকার এই লেখায় ট্রুডো বেশ কিছু শব্দ খরচের পরে তুলেছেন একটা জরুরি প্রশ্ন। বলা ভাল, প্রশ্নটা তাঁকে মনে করিয়েছেন স্ত্রী সোফি। মেয়ে এলাকে কী ভাবে এই অসাম্যের দুনিয়া থেকে তিনি সুরক্ষা দেবেন, তা নিয়ে যখন ভেবে আকুল ট্রু়ডো, সোফি যেন একটা ধাক্কা দেন তাঁকে। বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি তোমার ছেলেদের সে ভাবেই বড় করছ তো? যাতে ওরা নারী বা বালিকাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে গলাটা তুলতে পারে?’

প্রশ্নটা শুনেই ট্রু়ডো তাঁর লেখার শিরোনাম ঠিক করেছিলেন কি না, জানা নেই। তবে প্রশ্নটা এ সময়ে দাঁড়িয়ে বার বার করে যাওয়ার কতগুলো সুফল আছে।

‘নারীবাদী’ শব্দটা শুনলেই অনেক নারী এবং পুরুষ কয়েক যোজন ছিটকে যান। সেই ছুটে পালানোয় কৌতুক থাকে। উপেক্ষা থাকে। কখনও বা রেগেমেগেই ‘বেরো! নারীবাদী এসেছে!’ ট্রুডো কিন্তু এইখানটাতেই সাবধান করতে চান তাঁর ছেলেদের। লিখছেন, ‘পুরুষত্বের সেই বিশেষ চাপটা যেন ওদের বইতে না হয়। সেটা পুরুষের পক্ষেই ভয়ংকর।’ সহজ কথায় বললেন, ‘আমার অধিকারটাই তোমারও অধিকার, তোমার অধিকারটা যখন পুরোপুরি রক্ষা করা যাবে, তখন আমারটাও রক্ষিত হবে। এই বোধটুকু থাকলেই হবে।’

দুর্ভাগ্য, অধিকাংশের মধ্যে এই বোধটুকুই কাজ করে না। কিন্তু বোধটা কাজ করানোর জন্য আমরা কতটা কাজ করি? আমরা, যারা সন্তানদের ‘আদর্শ মানুষ’ করে তোলার কথা ভেবে হাজারটা ঝক্কি সামলাচ্ছি, আমরা কি কখনও ছেলেপিলেদের মনে এই বোধ চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি? না কি আমরা নিজেরা যেমনটা ছোট থেকে দেখে জেনে বুঝে বড় হয়ে এসেছি, সেটাই মাথায় নিয়ে এগিয়ে যাই?

এই যুগে অনেক শিশুকন্যার বাবা-মা’র মুখে চিন্তার ছাপ। কী হবে! বড় হয়ে কী আছে ওর কপালে! যা দিনকাল। এ দিনকালেই যে খুদে পুত্রের মা নিজের সন্তানকে বড় করছেন, তাঁকে কি কখনও তাড়া করে এ ভয়? কখনও কি তাঁর মনে হয়, এই ছেলে বড় হয়ে তেমন কিছু করবে না তো, যাতে কোনও মেয়ের অসম্মান হয়? কখনও কি সে মায়ের মনে হয়, যে বৈষম্য ঠেলতে ঠেলতে জীবনের এতটা পার করলাম, সেই বৈষম্য বয়ে চলার শিক্ষাই পাচ্ছে না তো আমার ছেলে? ছোট থেকেই শেখাচ্ছি না তো, আহা ও তো ছেলে, ওকে এত খাটিয়ো না। বলছি না তো, কেঁদো না কেঁদো না, ছেলেরা কি কাঁদে? ছেলেরা তো খুব সাহসী!

কথাগুলো খুব ক্লিশে। খুব চেনা, ঘ্যানঘেনে। কিন্তু বিশ্বের বহু পরিবারে এই শব্দ-বাক্য-ধারণাগুলোই রোজনামচা। আর সেই জন্যই আমাদের ছেলেগুলো ‘মানুষ’ হতে পারে না। আমরা হতে দিই না।

আজকাল কোথাও কোথাও এই মানুষ করার কাজটা শুরু হয়েছে। সেই কাজে সায় দিয়ে প্রত্যেকে যদি নিজের সদর্থক ভূমিকাটা পালন করি, তা হলে ‘নারীবাদ নারীবাদ’ বলে গলা না ফাটিয়েও হয়তো একটু সুফল মিলতে পারে। কিছু কিছু প্লে-গ্রুপ স্কুলে শুনেছি, চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে, ‘রেসপেক্ট গার্লস’। ছোটদের আর এক স্কুলে ছেলেমেয়েদের ইউনিফর্ম এক। সবার প্যান্ট, সবার টি-শার্ট। তবু এক খুদের রক্ষণশীল বাড়ি তাকে শেখাচ্ছিল, ছেলেরা প্যান্ট পরে, মেয়েরা নয়! তার মা খুদের মুখে শব্দগুলো শুনে শিউরে উঠেছিলেন। তার পরে ধৈর্য ধরে ছেলেকে স্কুলের কথা বলেই বুঝিয়েছিলেন, যার যা ভাল লাগে, সে তা-ই পরতে পারে।

শুধু এমন ছোট ছোট কথা নয়, জীবনযাপনেও কি আমরা এই স্বাভাবিকতা ছড়িেয় দিতে পারি না? পুত্রসন্তান বলে আহা-আহা না করে মা যদি তাকে বোঝান, তোমার কাজটুকু তোমাকেই করতে হবে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিতে হবে সে কথা। সব কিছু হাতের নাগালে এগিয়ে দেবে না কেউ। মা-প্রেমিকা-বউমা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না তোমার ছাড়া কাপড় তুলে ভাঁজ করে আলমারিতে রাখার জন্য, নোংরা কাপড় কেচে দেওয়ার জন্য, ভাত বেড়ে দেওয়ার জন্য। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু না পারলে নয়, সেটুকু অন্তত জানতে হবে তোমায়। তা সে রান্না বলো, কাপড় কাচা বলো বা ঘরদোর সাফ— কোনওটাই শুধু মেয়েদের কাজ নয়। মানুষ হিসেবে সমাজে বেঁচে থাকতে গেলে এইটুকু করতে হবে তোমাকেও। দায়িত্ব ভাগ করে নিতেই পারো, তবে সব ভার অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারো না।

বেশ কিছু দিন আগে ‘লড়কে রুলাতে নহী’ নামে একটি ভিডিয়ো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাতে দেখানো হয়, ছোট থেকে একটি ছেলের বড় হয়ে ওঠায় ফিরে ফিরে আসছে ওই শব্দগুলো, ‘ছেলেরা আবার কাঁদে নাকি!’ তা সে ছোট্ট শিশুটি চোট পাক, বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করুক, বা পরীক্ষায় খারাপ ফল করুক বা বড় হয়ে প্রেম ভেঙে যাওয়ার কষ্ট পাক। লড়কে নহী রোতে! কিন্তু কেন? খুব সহজ। কান্না জিনিসটা মেয়েলি বলে! তাই একটা ছেলেকে নিজের ক্ষোভ-কষ্ট জমাতে জমাতে বড় হতে হবে। শেষ পর্যন্ত ভিডিয়োটিতে দেখা যায়, ছেলেটি বড় হয়ে নিজের স্ত্রীর উপর শারীরিক নির্যাতন করছে। তখন এক সেলেব্রিটি এগিয়ে এসে বলেন, সবাই ছোট থেকে শেখায়, ছেলেরা কাঁদে না। ছেলেরা কাঁদায় না, এটা কি কেউ বলে?

বলার অভ্যেসটা বাড়ালে ছেলেগুলো যদি মানুষ হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gender Gender Discrimination society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE