মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে যত সম্পদ, তাহা দরিদ্রতম সত্তর শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের সমান— ২০২০ সালের ভারত এই সত্যটির সম্মুখীন। এই বিপুল অসাম্যকে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। এবং, তাহার দায় ঐতিহাসিক। স্বাধীন ভারতের দিকনির্দেশক নীতিগুলি যখন নির্ধারিত হইতেছে, তখন অসাম্য দূরীকরণ ছিল তাহার অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর। জওহরলাল নেহরুর ভারতচিন্তার কেন্দ্রে ছিল অসাম্যলাঘব। তাহার জন্য যাবতীয় সম্পদের রাষ্ট্রায়ত্তীকরণ প্রয়োজন ছিল না— মিশ্র অর্থনীতির স্কন্ধেই এই দায়িত্ব সমর্পণ করিবার কথা বলিয়াছিলেন নেহরু। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে স্বয়ং তিনিই সেই অসাম্যলাঘবের নীতিতে অবিচল থাকিতে পারেন নাই। কিন্তু, অসাম্য-ভাবনা হইতে ভারতকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত করিবার কৃতিত্বটি ইন্দিরা গাঁধীর প্রাপ্য। তাঁহার ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান ঘোষণা করিয়াছিল, অতঃপর রাষ্ট্র শুধু দারিদ্র দূরীকরণেই নজর দিবে। তৎপরবর্তী অর্ধশতকে দারিদ্রের প্রশ্নটিকে রাষ্ট্র কী ভাবে দেখিল, সেই আলোচনা অন্যত্র— কিন্তু, অসাম্যের কথা আর বলিল না। মনমোহন সিংহের অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন, এবং নরেন্দ্র মোদীর ‘ট্রিক্ল ডাউন’-মন্ত্র, এই দুইয়ের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক, কিন্তু মিল এক জায়গায়— অসাম্য যদি ক্রমবর্ধমান হয়ও, দুই নীতির কোনওটিই তাহাতে আপত্তি করিবে না। সত্য হইল, রাষ্ট্র ট্রিক্ল ডাউন-বাদী হইলে অসাম্য দ্রুততর হারে বাড়িবার সম্ভাবনা প্রবল, বিশেষত যদি বাজার পূর্ণ রূপে বিকশিত না হয়। মোদীর ভারত সেই বাস্তব প্রত্যক্ষ করিল। কিন্তু, এই বিপুল অসাম্যের দায়টি যে একাকী নরেন্দ্র মোদীর নহে, এই কথাটিও একই সঙ্গে স্মরণে রাখা বিধেয়।
বর্তমান ভারতে অসাম্য বিপুল। কিন্তু, তাহাতে আপত্তি থাকিবার কারণ কী? প্রথমত, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে এই অসাম্য আত্মঘাতী। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বর্তমানে যে মন্দা পরিস্থিতির সম্মুখীন, তাহার মূল কারণ চাহিদার অভাব। ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য সেই চাহিদার অভাবকে তীব্রতর করিতেছে। সমান পরিমাণ আয় বা সম্পদ বাড়িলে ধনীর তুলনায় দরিদ্র মানুষের ভোগব্যয় অনেক বেশি অনুপাতে বাড়ে। অর্থাৎ, কতিপয় অতিধনীর হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হইবার পরিবর্তে যদি অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের হাতে সেই সম্পদ বণ্টিত হইত, তবে দেশে সার্বিক ভোগব্যয়ের পরিমাণ বাড়িত। অতএব, চাহিদাও বাড়িত। কেহ প্রতিপ্রশ্ন করিতে পারেন যে অতিধনীদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হইলে বিনিয়োগের হার বাড়ে— তাহাতেও জাতীয় আয় বাড়িবে। ভারত সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় জানে যে কথাটি সত্য নহে। কেন, তাহাও স্পষ্ট— বাজারে চাহিদা না থাকিলে, পুঁজিপতিদের হাতে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তাঁহারা লগ্নি করেন না। কিন্তু, অসাম্যের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর আপত্তি আছে। ক্রমবর্ধমান অসাম্য, অর্থাৎ সমাজের অধিকাংশ মানুষের হাতে অনুপাতে সম্পদের পরিমাণ কমিতে থাকা উন্নয়নের ধর্মের পরিপন্থী। ন্যায্যতার যে কোনও সংজ্ঞাই একটি মৌলিক শর্ত পালন করিতে বলিবে— সমাজের প্রতিটি মানুষ যাহাতে উন্নয়নের সমান সুযোগ পান, তাহা নিশ্চিত করা। সম্পদ বণ্টনে প্রবল অসাম্য থাকিলে স্বভাবতই সিঁড়ির নীচের ধাপে থাকা জনগোষ্ঠী ‘স্বক্ষমতা’ অর্জন করিতে ব্যর্থ হইবে। নাগরিকের মঙ্গলকামী রাষ্ট্রের পক্ষে এই অবস্থা অসহ্য। এক্ষণে একটি কথা স্পষ্ট বলা প্রয়োজন— ভারতে যে অসাম্য তৈরি হইয়াছে, তাহার দায় মূলত সরকারের, বাজারের নহে। বাজারকে আপন ধর্মে অবিচলিত থাকিতে দিলে বহুতর মানুষের নিকট স্বাভাবিক ভাবেই উন্নয়নের সুফল পৌঁছায়। প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি না করিলে, সাঙাৎতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিলে তবেই এই অসাম্য তৈরি হয়। তাহা সংশোধনের দায়িত্বও, অতএব, রাষ্ট্রেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy