Advertisement
১১ মে ২০২৪
এমনকি সম্রাট অশোকও
Tribal

জনজাতির মানুষের সঙ্গে মানসিক দূরত্বই আমাদের ঐতিহ্য

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসটিতে ফের চোখ বোলালাম।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০০:০৮
Share: Save:

এক দিকে বিক্ষোভ, বিদ্রোহ আর অন্য দিকে আদেখলেপনা, অনেক হল। এখন মানসিকতার বদল জরুরি। সাঁওতাল, শবর, মুন্ডা প্রমুখ জনজাতিকে অযথা রোমান্টিক দৃষ্টিতে প্রত্নজীব না ভেবে, সহনাগরিক হিসেবে ভাবতে হবে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা কিংবা সুস্থ জীবনের অধিকারগুলি তাঁরা পর্যাপ্ত পাচ্ছেন তো?

প্রতীচী ট্রাস্ট ও এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে তৈরি জনজাতি নিয়ে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা-রিপোর্ট (লিভিং ওয়ার্ল্ড অব দি আদিবাসিজ় অব ওয়েস্ট বেঙ্গল) পড়তে পড়তে আচমকা ধাক্কা খেলাম। সত্যিই তো, জনজাতিদের সহনাগরিক হিসেবে আজও দেখতে শেখায়নি আমাদের সংস্কৃতি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসটিতে ফের চোখ বোলালাম। সত্যজিৎ সিনেমা করতে গিয়ে গল্পটি অনেকাংশে বদলে দিয়েছিলেন। গল্পের চারটি ছেলে— গাড়িতে নয়— ট্রেনে করে ধলভূমগড় যায়। রবি, শেখর, সঞ্জয়েরা স্টেশনে নেমেছে। বাঙালি টিকিট চেকার জানান, ‘এখানে কিচ্ছু পাওয়া যায় না স্যার। জংলিদের জায়গা, মাছ নেই, দুধ নেই।’ চাকরিসূত্রে দিনের পর দিন ধলভূমগড়ে থাকেন, কিন্তু এলাকাটিকে তিনি ‘জংলিদের জায়গা’ ভাবতেই অভ্যস্ত।

সুনীল অবশ্য ঐতিহ্যে স্থিত। স্বাধীনতা এবং কৃত্তিবাস-প্রজন্মের ঢের আগে বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পালামৌ সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে কয়েকটি কোল বালকের সঙ্গে তাঁর দেখা। কানে ফুল আর গলায় গোল আরশি লাগিয়ে তারা মোষ চরাচ্ছে। তার পরই তাঁর বিখ্যাত লাইন, ‘স্বদেশে কোলমাত্রেই রূপবান... বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ বুনো মোষ, শুয়োর আর সজারুর সঙ্গে জনজাতি বালকেরা একাকার।

এই মানসিক দূরত্ব থেকেই অজ্ঞতার জন্ম। অজ্ঞতা যে কত রকমের! যেমন, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ৪০টি জনজাতি আছে, কিন্তু বাঙালির কাছে সবাই সাঁওতাল। ঝাড়গ্রাম, গিধনির দিকে খড়্গপুরের পর লোধাশুলি নামে একটা জায়গা আসে। জায়গাটিতে সাঁওতাল নয়, লোধা শবর জনজাতিই সংখ্যায় বেশি। লোধাশুলি নাম কেন? ১৭৬৩ সালে কুশু আড়ি নামে বিদ্রোহী এক শবর নেতাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফাঁসি দেয়। (সেই জায়গাটিরই পরে নাম হয় কেশিয়াড়ি।) সাত জন লোধা-শবর নেতাকে শূলে চাপিয়ে হত্যা করা হয়। এখনও জঙ্গলমহল ঝুমুর গান বাঁধে, ‘কেশু আড়ির ফাঁসি হৈল্য, রঘুনাথ মাহাতো বাঁধাই গেল।’ সাঁওতাল আর শবরদের তফাত, সহনাগরিকদের ইতিহাসটি ঠিকঠাক জানলে অন্তত দেশপ্রেমের ঠিকাটি হিন্দুত্ববাদীরা অক্লেশে আত্মসাৎ করতে পারত না।

প্রায় দু’বছর ধরে ২৪ জন গবেষক রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা জায়গায় জনজাতির লোকদের সঙ্গে কথা বলে ২৬৬ পৃষ্ঠার যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন, সেখানে চমকপ্রদ হরেক তথ্যের সম্ভার। নিরক্ষর কুনি মহুলি, শান্তি শবরেরা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি। মেয়ে হয়ে জন্মানোয় বাড়ির কাজ, জঙ্গল থেকে গোবর ও শুকনো ঘাসপাতা কুড়িয়ে আনা, অনেক কিছুই করতে হত। আজকাল জোরজার করে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে দেন তাঁরা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য নয়। ‘‘ওরা বড়লোক হবে, সে আশা করি না। কিন্তু একটু লেখাপড়া জানলেও তো লজ্জা থেকে রেহাই পাবে’’, বলছেন কুনি। জনজাতির দরিদ্র মা যখন নিজেই উপলব্ধি করেন, সন্তানদের সামান্য অঙ্ক এবং ভাষাশিক্ষা না হওয়াটা লজ্জার ব্যাপার, ভরসা জাগে। ভরসা জাগে, যখন পড়ি, উত্তরবঙ্গের গ্রামে ক’জন বাঙালি শিক্ষক রাভা জনজাতির ভাষা শিখে সেই ভাষায় স্কুলে ক্লাস নিচ্ছেন। জনজাতির অজানা ভাষার দূরত্ব থেকেই তো বাঙালি বলে, ‘ওরা আকাট। হাজার চেষ্টাতেও মাথায় লেখাপড়া ঢুকবে না।’

এ রকমই কিছু সাফল্যের পাশাপাশি এই রিপোর্ট জানিয়েছে, এখনও যেতে হবে বহু দূর। আগে হয়তো যাঁর খাওয়া জুটত না, এখন তিনি অন্তত এক বেলা খেতে পান। কিন্তু পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে, জঙ্গল কাটা পড়েছে। ফলে গেঁড়ি-গুগলি তথা প্রোটিনে টান পড়ে। শিক্ষার অধিকার আইনে বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক স্কুল থাকার কথা বলা হলেও, এখনও অনেককে দুই-আড়াই কিলোমিটার যেতে হয়। জনজাতির হাতে জমি অল্প, ফলে জঙ্গলে গিয়ে মহুয়া ফুল কুড়নো, শালপাতার ঠোঙা, বাবুই ঘাসের দড়ি তৈরি, জন খাটতে যাওয়া ইত্যাদি করতে হয়। পড়তে পড়তে ফের অরণ্যের দিনরাত্রি মনে পড়ল। শেখর, সঞ্জয়েরা হাটে গিয়েছে। দুলি ও অন্য মেয়েরা ঝুড়ি নিয়ে বসে। শেখরেরা খোঁজ করে, ডিম আছে? হাটের এক জন জানায়, ‘ওরা ডিম বেচে না। জন খাটে বাবু।’— ‘জন খাটে মানে?’— ‘রাজমিস্ত্রির কাজে জোগান দেয়, ইট বয়।... ইখানে বসে থাকে, যদি কারও দরকার হয়, ডেকে পাঠাবে।’

এই রিপোর্ট সাহিত্যের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে স্তব্ধ হয়ে যেতেই হয়। এস ওয়াজেদ আলি বুকে গুনগুন করেন।

অরণ্যের অধিবাসীদের নির্বিচার ধ্বংস করাই আমাদের ট্র্যাডিশন। মহাভারতের আদিপর্বে অর্জুন তাঁর গাণ্ডীব ধনু, অক্ষয় তূণীর এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সুদর্শন চক্র পেলেন কখন? খাণ্ডববন পোড়ানোর অব্যবহিত আগে অগ্নিদেব তাঁদের সেগুলি উপহার দিলেন। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে অগ্নি সাত বার খাণ্ডবদাহন করেছেন। কিন্তু এ-বারেরটা অন্য রকম। কালীপ্রসন্ন সিংহের বর্ণনায়, ‘শত শত প্রাণী ভয়ঙ্কর চিৎকার করিতে করিতে ইতস্ততঃ প্রধাবিত হইতে লাগিল।... কেহ কেহ পিতা, পুত্র ও ভ্রাতৃগণকে আলিঙ্গন করিয়া স্নেহবশতঃ তাঁহাদের পরিত্যাগ করিতে না পারায় প্রাণত্যাগ করিল।’ অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশায় জনজাতিদের উৎখাত করে উন্নয়নের ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করা মহাভারতীয় উত্তরাধিকার।

কিংবা, খাণ্ডবদাহনেরও আগে জতুগৃহ ছেড়ে পাণ্ডবদের পালানোর গল্প। বিদুর বিশ্বস্ত খনককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পরিখা থেকে মাটি তোলার ছলে সে প্রায় ছ’মাস ধরে সুড়ঙ্গ খোঁড়ে। পরের ঘটনা সবাই জানেন। ‘কালপ্রেরিত’ নিষাদী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়ে আসে, পাণ্ডবগৃহে প্রচুর মদ্যপান করে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে কুন্তীকে নিয়ে পাণ্ডবেরা পালিয়ে যান। নিমন্ত্রিতেরা সবাই ফিরে গেল, নিষাদী ও তার পুত্রেরা মাতাল হয়ে জতুগৃহে থেকে গেল। নিষাদ তো, মাতাল হবেই! এর জন্য ধর্মরাজের কোনও দিন শাস্তি হবে না। এই মহাভারতীয় সংস্কৃতিতে জনজাতিদের সহনাগরিক ভাবাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতীচী রিপোর্ট পড়ে মনে হল, সেই চ্যালেঞ্জ জেতাটাই আশু কর্তব্য। দু’কিলোমিটার দূরের স্কুল হয়তো এক দিন এক কিলোমিটারের মধ্যে আসবে, চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে জনজাতি নারী পুরুষদের যথাযথ প্রোটিনও জুটবে। কিন্তু তাঁদের সহনাগরিক ভাবা আরও অনেক কঠিন।

তেমন ভাবনার রাস্তা কোনও দিনই খুঁজে পায়নি এ দেশের সংস্কৃতি। বুদ্ধদেব বসুর মৌলিনাথ নামে একটি চমৎকার উপন্যাস আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহু বার ওটিকে তাঁর প্রিয় উপন্যাস বলেছেন। তার শেষ পর্বে মৌলিনাথ চলে এসেছে সিংভূমের জনজাতি গ্রামে, ‘‘রক্ত এখানে আদিম ছন্দে লাফায় এখনও, ইস্পাতের ফলা-পরানো নখ দিয়ে পরস্পরের টুঁটি ছেঁড়ে জঙ্গি মোরগ, যুবতীদের জাপটে ধরে টেনে নিয়ে যায় পাণিপ্রার্থীরা— আর মেয়েরা হাসতে হাসতে অপহৃত হয়।’’ এই মেদুর রোমান্টিকতাও তো জন্মায় জনজাতিকে অচেনা প্রত্নজীব ভাবার অভ্যেস থেকেই!

রিপোর্টের মুখবন্ধে অমর্ত্য সেন সম্রাট অশোকের কথা উল্লেখ করেছেন। মহাভারতীয় ট্র্যাডিশনের বাইরে বেরিয়ে তিনিই পঞ্চম শিলালেখে প্রথম ঘোষণা করেছিলেন, প্রাণীহত্যা বা অন্য কোনও কারণে জঙ্গল পোড়ানো যাবে না।

প্রশ্ন অন্যত্র। ময়না, চক্রবাক, রাজহাঁস, গোসাপ, সজারু শিকারও নিষিদ্ধ করেছিলেন অশোক। ১৩ নম্বর শিলালিপিতে তাঁর হুঙ্কার: আটবিক, অর্থাৎ অরণ্যের অধিবাসীরা শিকার বন্ধ না করলে ব্যবস্থা করা হবে। মহারাজ বৌদ্ধ, শিকার ছেড়ে দিয়েছেন, অতএব তাঁর অরণ্যচারী প্রজাদেরও অমনটাই করতে হবে! বনবাসীদের উৎসবে মদ-মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন অশোক। এ যেন রাজা নিরামিষাশী বলে সবাইকে নিরামিষ খাওয়ানোর প্রয়াস।

ইতিহাসবিদ ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে জানিয়েছেন, বনবাসীদের উৎসব বন্ধে অশোক যা-ই করে থাকুন না কেন, ধোপে টেকেনি। পরে অনেক রাজা জৈন এবং বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বনবাসীদের উৎসবে হাত দেননি।

যে ক্ষেত্রসমীক্ষা শুকনো পাই-চার্ট আর গ্রাফের বাইরে বেরিয়ে মানুষের কথা বলে, যাকে সাহিত্যের বয়ানের সঙ্গে মিলিয়ে অন্য ভাবে পড়া যায়, যা মহাভারতীয় অভ্যাস এবং অশোকের শিলালেখের বাইরে বেরিয়ে আজকের দুনিয়ায় জনজাতিদের সহনাগরিক হিসেবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে, তার বৈশিষ্ট্য বা গুরুত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sunil Gangopadhyay Satyajit Ray Tribal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE