Advertisement
E-Paper

আনন্দের আরাধনা

রাস্তার আলোকমালা, নূতন জুতার অনিবার্য ফোসকা এবং মধ্যরাত্রের লোভী আইসক্রিম তাঁহাদের সেই আনন্দের ছোঁয়া দেয়। শহর জুড়িয়া কার্নিভাল। যাহাকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসব, সেই দুর্গাপূজা হিন্দুধর্মের।

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০

শহর কলিকাতার চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। এখন অলিতে-গলিতে উৎসব, রাজপথে উজ্জ্বল জনতার ভিড়। সংবৎসরের প্রাত্যহিকতা বাদ রাখিয়া মানুষ এই কয় দিনের উৎসবে মাতিয়াছে। পথের ধারের রোলের দোকানের সম্মুখে, এয়ারগানের গুলিতে বেলুন ফাটাইবার ছেলেমানুষি ফুর্তিতে, এবং অতি অবশ্যই প্যান্ডেলে প্রবেশ করিবার অতি দীর্ঘ লাইনে যে মুখগুলিকে দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহারা আনন্দের খোঁজে পথে নামিয়াছেন। রাস্তার আলোকমালা, নূতন জুতার অনিবার্য ফোসকা এবং মধ্যরাত্রের লোভী আইসক্রিম তাঁহাদের সেই আনন্দের ছোঁয়া দেয়। শহর জুড়িয়া কার্নিভাল। যাহাকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসব, সেই দুর্গাপূজা হিন্দুধর্মের। কিন্তু, বাঙালি সাক্ষী, নেহাত আহাম্মকও দুর্গাপূজায় ধর্ম খুঁজিয়া ফিরে না। উপবাসে থাকিয়া নূতন কাপড় পরিয়া বাঙালি অষ্টমীর অঞ্জলি দেয় বটে, কিন্তু অগণন কিশোরের স্মৃতিতে সেই মুহূর্তগুলি ধর্মাচরণের কারণে ধরা নাই, আছে পাড়ার কোনও কিশোরীর হাতে অঞ্জলির ফুল তুলিয়া দেওয়ার মুহূর্তে ক্ষণিকের স্পর্শের কারণে। এইখানেই দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য। প্রাণের পরশ আসিয়া, আনন্দ আসিয়া ধর্মকে লইয়া গিয়াছে। বস্তুত, উৎসবটি যে মূলত ধর্মের, এই কথাটি বিস্মৃত হওয়াও আশ্চর্যের নহে। মুসলমান দম্পতি শিশুপুত্রটিকে কাঁধে চাপাইয়া ঠাকুর দেখিতে বাহির হইয়াছেন, অথবা শিখ যুবক পূজার অন্যতম কর্মকর্তা, এমন দৃশ্য হামেশাই চক্ষে পড়িয়া যায়। দুর্গাপূজা সর্বজনের। ধর্মের নামাবলিটি সন্তর্পণে নামাইয়া রাখিতে না পারিলে এই সর্বজনীনতা অর্জন করা সম্ভব হইত না। বাঙালি তাহা পারিয়াছে। এই অর্জনকে আপ্রাণ রক্ষা করাই কর্তব্য। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের প্রতিনিধিরা বাঙালিকে পূজা সংক্রান্ত জ্ঞান দিতে আসিলে তাহাদের বলিয়া দেওয়া বিধেয়, এই উৎসবটিকে তিলমাত্র বদলাইতে বাঙালি নারাজ।

দুর্গাপূজা যে ধর্ম নহে, উৎসব, তাহার মোক্ষম প্রমাণ মণ্ডপগুলি। দূরদূরান্ত হইতে মানুষ ভিড় ঠেলিয়া যাহা দেখিতে আসেন, তাহা কখনও চায়ের ভাঁড়ের তৈরি, কখনও সাইকেলের। কখনও তাহাতে রাজস্থানি শিল্পকলা, কখনও আফ্রিকার। সেই সৃষ্টির শিল্পগুণ কতখানি, তাহা অন্যত্র বিচার্য, কিন্তু মানুষ তাহাই দেখিতে আসেন। যে পূজায় ধর্মই মূল, সেখানে যে এমনটা হয় না, হইতে পারে না, গোটা ভারত জুড়িয়া তাহার নিদর্শন আছে। বাঙালি বারে বারেই প্রমাণ করে, দুর্গাপূজাকে অন্য কোনও ধর্মীয় উৎসবের সহিত গুলাইয়া ফেলিলে বড় ভুল হইবে। পশ্চিমবঙ্গের সব সর্বজনীনের একটিই থিম: আনন্দ করো, আনন্দে মাতোয়ারা হও। শারদোৎসবে আনন্দই মুখ্য। এবং, সেই কারণেই এই উৎসব চরিত্রে পৃথক। মহৎও।

আনন্দের একটি বিপরীত দিকও আছে। হরেক পুরস্কারের হাওয়া পালে লাগায় সর্বজনীন পূজাগুলির উৎসাহবৃদ্ধি হইয়াছে। তাহারা আরও জোর ঝাঁপাইয়াছে। তাহার ঠেলা সামলাইতে হয় স্থানীয় মানুষকে। যাঁহাদের যাতায়াতের পথ তিন মাস বন্ধ হইয়া থাকে, পূজার কয় দিন যাঁহাদের বাড়ি হইতে বাহির হওয়ার কার্যত কোনও উপায় থাকে না। অসুস্থ হইলে অ্যাম্বুল্যান্স আসিবে, রাস্তায় ততটুকু ফাঁকও অনেক স্থানেই নাই। প্রতিবাদ করিয়া মার খাইবার হঠকারিতা বেশির ভাগ মানুষই করেন না। ফলে, চতুর্থীর দিন বাজার সারিয়া সদর দরজা আঁটিয়া পথের কোলাহল শুনিয়া পূজা উপভোগ করা ভিন্ন তাঁহাদের আর বিশেষ কিছু করিবার থাকে না। পুরস্কারদাতারা কি এই দিকটির কথা স্মরণে রাখিতে পারেন না? কোন পূজার মণ্ডপ বা প্রতিমা কতখানি চিত্তাকর্ষক হইয়াছে, নিশ্চয়ই তাহা বিবেচনা করিবেন। কিন্তু, সেই পূজাটি স্থানীয় মানুষকে কতখানি বেকায়দায় ফেলিতেছে, তাহাও কি একই সঙ্গে বিবেচ্য নহে?

Durga Puja Festival
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy