Advertisement
০৩ মে ২০২৪
ব্যক্তিসর্বস্বতা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল তৈরি হয় না

শুধু ঘোষণা আর প্রতিশ্রুতি

পয়লা ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি পঞ্চম বাজেট পেশ করতে চলেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে এটাই শেষ বাজেট, যার ঘোষণা দেশের অর্থনীতির সংকটের দাওয়াই বাতলাবে।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

দে শের প্রধানমন্ত্রী তখন নরসিংহ রাও। ১৯৯৪ সালে তাঁর নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে বিধানসভা ভোটে হেরে ভূত কংগ্রেস। রাওয়ের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর বাজেটে কিছু দিন আগেই আর্থিক সংস্কারের বেশ কঠোর দাওয়াই ঘোষণা করেন। পরাজিত মুখ্যমন্ত্রী বিজয় ভাস্কর রেড্ডি দিল্লি এলেন ওয়ার্কিং কমটির বৈঠকে যোগ দিতে। সে-দিন অনেক রাত পর্যন্ত বৈঠক গড়াল। রাগে অগ্নিশর্মা রেড্ডি। মনে পড়ে, মানুষটা ছিল খুব লম্বা আর বাজখাঁই কণ্ঠস্বর, সবাই ডাকত ‘কোটলা’ বলে। ধুতিপরিহিত কোটলা সে-দিন অনেককে সঙ্গে নিয়ে ভোট-বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করলেন ‘ডক্টর সাহিব’কে। প্রধানমন্ত্রী তখন তেলুগু বিড্ডা রাও সাহেব হলেও কাঠগড়ায় সে দিন সর্দারজি বা ডক্টর সাহিবই। এনটিআর অর্থাৎ এনটি রামা রাও তখন মুখ্যমন্ত্রী। কোটলা বললেন, এনটিআর অন্ধ্রে দু’টাকা কিলো চাল দেবে বলেছেন। আর আমরা করছি ‘রিফর্ম’? সর্দারজির কণ্ঠস্বর সে-দিনও ‘মৃদু’। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে চাইলেন। কেউ শুনতেই চাইলেন না। বিবাদ নিরসনে চিরকালের মধ্যস্থতাকারী প্রণব মুখোপাধ্যায় (তখন যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ) বললেন, আর্থিক সংস্কার হোক, তবে ‘উইথ হিউম্যান ফেস’। অর্থাৎ কিনা মধ্যপন্থা। রাওসাহেব কোটের ওপর সাদা শাল ভাঁজ করে রাখতেন: শাল আর বিক্ষুব্ধ পক্ষকে যৌথ ভাবে সামলে জানালেন, রাজ্যে হেরে গেলেও মনমোহন সিংহের সংস্কারের পথই ঠিক পথ।

পয়লা ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি পঞ্চম বাজেট পেশ করতে চলেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে এটাই শেষ বাজেট, যার ঘোষণা দেশের অর্থনীতির সংকটের দাওয়াই বাতলাবে। মানুষ আর রাষ্ট্র বা সরকারের পারস্পরিক সম্পর্কের নির্ধারণে আজও দেশের বাজেটের বড় ভূমিকা। আর তাই সেই ১৯৯৪ সালের বিতর্কের ভূত তাড়া করছে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে।

রাও-মনমোহন হাজারো সমালোচনার মধ্যেও সে-দিন আর্থিক সংস্কারের প্রশ্নে গতিমুখ বদলাননি। আইএমএফ-এর কাছে ঋণ নিতে গিয়েছেন দ্বিধাহীন ভাবে। ১৯৯১ সালে এক সাক্ষাৎকারে মনমোহন বলেছিলেন, ‘আর্থিক ধার প্রচুর। ঘাটতি ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক সুদের হার প্রবল। ফলে আর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এই ঋণ নিয়ে বদলাব। বিশ্বের উদার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করব ভারতকে।’ ভোটের ফলাফলের কথা না ভেবেই সে-দিন মনমোহন ওই তেতো ওষুধ দেন। লক্ষ্যভেদও করেন। আজ যিনি অরুণ জেটলির আর্থিক উপদেষ্টা, সেই সঞ্জীব সান্যাল সে-দিনের রাও-সংস্কারের উপর একটি বই লেখেন, যাতে তিনি বলেন ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কার হল ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন।

আর গত তিন বছরে নরেন্দ্র মোদী কী করলেন? ২০১৪-র বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারটা একবার পড়ে দেখুন, কত ঘোষণা। আজ ২০১৮ সালে, হাতে কিন্তু সেই পেনসিল। এক কোটি নতুন চাকরির প্রতিশ্রুতি ছিল, নতুন অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেও দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থান হয়েছে অতি নগণ্য পরিমাণ। কালোবাজার রুখতে বিশেষ আদালত গঠন? হয়নি। দামের ভারসাম্য তহবিল গঠন? হয়নি। জাতীয় কৃষি বাজার— কোথায় সেটা? তাড়াহুড়ো করে সরকার অনেক ঘোষণা করছে বটে, কিন্তু আজ আমাদের দেশে গত তিন বছরে উৎপাদনের পরিসংখ্যান দুঃখজনক, কৃষিবৃদ্ধির হার হতাশায় নিমজ্জিত। মজার ব্যাপার, ২০১৪ সালের ভোটের আগে মোদী-সমর্থক জগদীশ ভগবতী বা অরবিন্দ পানাগড়িয়ার মতো অর্থনীতিবিদরাই ভেবেছিলেন এ-বার মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় অর্থনীতি গতানুগতিক বামপন্থী ভরতুকি-অর্থনীতিকে পরিত্যাগ করে দক্ষিণপন্থী সংস্কারের সাহসী পথে এগোবে। অনেকে তো ভাবতে শুরু করেন এ-বার বোধহয় রিপাবলিকান দলের ভারতীয় সংস্করণ হয়ে উঠবে মোদীর বিজেপি। দক্ষিণপন্থী সংস্কারই যে ভারতীয় অর্থনীতির সংকটমোচন দাওয়াই, এ কথা বলছি না, কিন্তু এটা বলতেই হবে, তিন বছরে দিশাহীন মোদীও বুঝে গিয়েছেন, আর্থিক বৃদ্ধি দরকার হলেও ভোটে জেতার জন্য রাজনৈতিক পপুলিজম বিনা গতি নেই।

জগদীশ ভগবতী একদা বলেছিলেন, ‘ভারতের অর্থনীতির ব্যর্থতার আসল কারণ, উৎপাদনহীনতা। যথেষ্ট সঞ্চয়ের অভাব আর দুর্বল রফতানি।’ ১৯৫০ থেকে ১৯৮৪ সালের আর্থিক উন্নয়নের করুণ চিত্র তুলে ধরেছিলেন তিনি। আজ তিন বছর পর সেই একই অভিযোগ। উৎপাদন নেই। কাজ নেই। কৃষকের অবস্থা শোচনীয়। উলটে বিমুদ্রাকরণ আর জিএসটির ফলে শুধু ধনী কালোবাজারি শ্রেণি নয়, সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তেরও নাভিশ্বাস। সরকারও তা বুঝেছে গুজরাত ভোটের ফল দেখে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার বিপদ অনেক। এই বিপদ থেকে ইন্দিরা গাঁধী পর্যন্ত বাঁচতে পারেননি। ওঁর উপদেষ্টা পি এন হক্সর বলেছিলেন, ‘ইন্দিরার কংগ্রেসকে যতটা দরকার ছিল, কংগ্রেসের ইন্দিরাকে দরকার ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি।’ কিন্তু সেই পপুলিস্ট নেত্রী ইন্দিরা জনমোহিনী ভূমিকা থেকে জরুরি অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে বলা হত, তিনি এক কঠিন কঠোর ব্যক্তিত্ব। যা ঠিক মনে করেন, তা তিনি করবেনই। পিছু হটবেন না। তিনি যা করছেন তাতেই মানুষের কল্যাণ। সেই পপুলিস্ট নরেন্দ্র মোদীকে আজ বলতে হচ্ছে, মিস্টার রোলব্যাক।

জিএসটি নিয়ে তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কী বলেছিলেন আর কী করলেন? আবার ভোটের ভয়ে বার বার জিএসটি-কে লঘু করার চেষ্টাই বা করলেন কেন? আধার নিয়ে মোদী কী বলেছিলেন? বিজেপি বিরোধিতা করেছিল ২০১৪ সালে, পরে মোদী বললেন, ‘ইউপিএ সরকারের আধার ছিল ত্রুটিযুক্ত।’ তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আধারকে ত্রুটিমুক্ত করছেন। রিটেল মাল্টিব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে ইস্তাহারে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিল, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হবে না। আর এখন এই আর্থিক সংকটে ক্যাবিনেট সেই বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্তই নিল। রাজ্যগুলির আর্থিক ঘাটতি দূর করার জন্য কেন্দ্র-রাজ্য সুসম্পর্ক প্রয়োজন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্প সম্মেলনে কোনও মন্ত্রী না-পাঠিয়ে যে রাজনৈতিক সংঘাত ও অসহিষ্ণুতার আবহ তৈরি করা হল, তা দিয়ে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক সম্পর্ককে কি উন্নত করা সম্ভব? মুখে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের কথা বলে কংগ্রেসমুক্ত তথা বিরোধীমুক্ত ভারত গঠনের আক্রমণাত্মক রাজনীতি করা কি উন্নয়নের ‘মডেল’?

মোদীজি এখন তাই দেশের অর্থনীতি নিয়ে দিকশূন্যপুরে পৌঁছে গিয়েছেন। তাই ভোটের কথা ভেবে, আরও নতুন নতুন ঘোষণা, নতুন নতুন ইভেন্ট তৈরিই মুক্তির পথ। তা সে দাভোসের নৈশভোজ হোক আর দেশে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রোড-শোই হোক। আজও বিজেপিতে মোদীই বিজেপি। মোদীই ইস্তাহার। মোদী প্রচারক। মোদী প্রতীক। মোদী স্লোগান। ভারত মানেই মোদী। এই পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদীই। কিন্তু ব্যক্তি নয়, ভারতের রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে প্রয়োজন একটা পথের ধারাবাহিকতা। নেহরু সেই ভারতীয় পথটার স্রষ্টা। সেই পথ থেকে সরে নতুন পথের স্বপ্ন দেখিয়ে, কিন্তু স্বপ্নপূরণে এক পা-ও না এগোতে পেরে মোদী আজ পথভোলা পথিক।

মোদীজি, আপনি ক্ষমতায় এসে এই যে বললেন, ‘সত্তর বছরে কিছুই হয়নি, নেহরু থেকে মনমোহন সবটাই ব্যর্থতার ইতিহাস, এ-বার আগমার্কা নতুন সরকার এক নতুন পথ দেখাবে’, এটা বোধহয় ভুল করলেন। বরং ভারত এই সত্তর বছরে যা অর্জন করেছে, তাকে তুচ্ছ না করে তার থেকেই আপনি আবার সুতো টানতে পারতেন।

১৫ অগস্ট রংবেরঙের পাগড়ি পরেন প্রধানমন্ত্রী। মানুষ যখন সম্মান হারাতে শুরু করে, তখন রাজস্থানের লোকায়ত মন্তব্য হল, ‘মহাশয়, পাগড়ি আটকি হ্যায়’। হে প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি টের পাচ্ছেন? পাগড়ি আটকে গেছে আপনার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE