Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

হাজার মনে, হাজার রকম শান্তিনিকেতন

শান্তিনিকেতনকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা, জানা ও বোঝার সুযোগ তো তাঁদেরই, যাঁরা এখানকার ছাত্রছাত্রী। বিদ্যালয় স্তরে যারা পড়তে আসে শান্তিনিকেতনে, তারা যেমন শান্তিনিকেতনকে অনেক বেশিদিন ধরে ও অনেক নিবিড় ভাবে পায়, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা আসেন অনেক পরিণত মন নিয়ে। তাঁদের শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বোঝা কিংবা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুল্যমূল্য আলোচনা করার ক্ষমতা বেশি। লিখছেন পারমিতা শান্তিনিকেতনকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা, জানা ও বোঝার সুযোগ তো তাঁদেরই, যাঁরা এখানকার ছাত্রছাত্রী। বিদ্যালয় স্তরে যারা পড়তে আসে শান্তিনিকেতনে, তারা যেমন শান্তিনিকেতনকে অনেক বেশিদিন ধরে ও অনেক নিবিড় ভাবে পায়, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা আসেন অনেক পরিণত মন নিয়ে। তাঁদের শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বোঝা কিংবা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুল্যমূল্য আলোচনা করার ক্ষমতা বেশি। লিখছেন পারমিতা

গল্প: বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে পড়ুয়ারা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

গল্প: বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে পড়ুয়ারা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৫
Share: Save:

বাঙালি মনে সূচনালগ্ন থেকেই শান্তিনিকেতন সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন সকলের কাছে একই মাত্রায় ধরা দেন না, কারও কাছে দেবতা, কারও কাছে রক্ত-মাংসের মানুষ, কারও কাছে তিনি দেবতুল্য মনীষী। আবার কারও কারও ব্যাখ্যায় অলীক অবাস্তব জগতে বিচরণকারী কবি এক, তেমনই তাঁর শান্তিনিকেতন সম্পর্কে মানুষের চেতনায় নিজস্ব নির্মাণ থাকে। যেমন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনকে বলেছেন রবীন্দ্রনাথের ইউটোপিয়া! আবার বুদ্ধদেব বসুর কাছে শান্তিনিকেতন ছিল ‘সব পেয়েছির দেশ’।

এতো গেল সেকালের কথা! এ কালের কথা? অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যখন ভাব-শান্তিনিকেতনের কথা বলেছেন, অথবা নীললোহিত বাংলাদেশি তরুণী পঙ্গু মরিয়মকে শুনিয়েছে কল্পনায় রচা স্বর্গতুল্য শান্তিনিকেতনের গল্প, সে-ও আজ হল কতকাল!

‘শান্তিনিকেতন আর আগের মতো নেই’ —এই আক্ষেপ প্রবাদবাক্যের মতো শুনে শুনে আমাদের বড় হয়ে ওঠা। এই ‘আগের মতো’টা কেমন, সে তর্ক না তুলেই বারবার নীরবে সমীক্ষা করে গিয়েছি নানা মানসের ছাত্রকাল থেকে, কৌতূহলবশে, নিজের মতো করে। আর তাতে দেখতে পেয়েছি, হাজার মনে হাজার রকমের শান্তিনিকেতন! দেখেছি পাঠভবন থেকে পড়া সহপাঠিনীকে বুধবারের সকালে মন্দিরের ঘণ্টা শুনে কানে বালিশ চাপা দিয়ে পাশ ফিরে শুতে, আর একই সঙ্গে দেখেছি চিন দেশ থেকে বাংলা পড়তে আসা মেয়েকে ওই মন্দিরে যাওয়ার জন্যই লালপাড় সাদা শাড়ি পড়তে শেখার স্থির ধৈর্য! সেও হল বছর বারো আগের কথা! অর্থাৎ একবিংশের গোড়ার
শান্তিনিকেতন তখন।

এই শতাব্দী সূচনা সময় থেকেই বিজ্ঞান এবং তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমগুলির গড়ে ওঠা ও ছড়িয়ে পড়া জনমানসে প্রভাব ফেলেছে খুবই বেশি রকম। একই সঙ্গে জীবনকে করেছে দ্রুততর থেকে দ্রুততম। মনে হল একদিন, ফর্ম ছাপিয়ে একটা লিখিত সমীক্ষাই করা যাক না, একবিংশের ছাত্রছাত্রীর মানসে ‘শান্তিনিকেতন’ নামক ‘আইডিয়া’টি কেমন রূপপ্রকৃতি পেল। সমীক্ষা করেছিলাম সংক্ষিপ্ত ও বৈকল্পিক প্রশ্নপত্রের ভিত্তিতে। বিশ্বভারতী বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদের হাতে দিয়েছিলাম ঈষৎ ভিন্ন দুই রকম ফর্ম। কেন তাঁরা শান্তিনিকেতনে এলেন পড়তে, শান্তিনিকেতনেই কেন? আগে জানতেন কিছু? আকর্ষণ ছিল? নাকি বাবা-মায়ের ইচ্ছেয় বা অন্য কোনও হিসেব? নাকি কিছুই নয়, নিতান্ত বাড়ির পাশে তাই!

শান্তিনিকেতনকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা, জানা ও বোঝার সুযোগ তো তাঁদেরই, যাঁরা এখানকার ছাত্রছাত্রী। বিদ্যালয় স্তরে যারা পড়তে আসে শান্তিনিকেতনে, তারা যেমন শান্তিনিকেতনকে অনেক বেশিদিন ধরে ও অনেক নিবিড় ভাবে পায়, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা আসেন অনেক পরিণত মন নিয়ে। তাঁদের শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বোঝা কিংবা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুল্যমূল্য আলোচনা করার ক্ষমতা বেশি। আমরা তাই এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পড়ুয়াদের মধ্যে করা সমীক্ষার ফলাফলকেই বেশি গুরুত্ব দিলাম। বিভিন্ন ভবনের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ৩৪ জন ছাত্রছাত্রীকে বেছে নেওয়া হয়েছিল আমাদের সমীক্ষার জন্য, যাঁদের মধ্যে ৩০ জন আবাসিক এবং বাকি চার জন অনাবাসিক ছাত্রছাত্রী ছিলেন। এই ৩০ জনের মধ্যে ২২ জন ছাত্রছাত্রীই জানিয়েছেন যে, তাঁরা শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছেন এখানকার শিক্ষাভাবনা, প্রকৃতির সান্নিধ্য, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে আকৃষ্ট হয়ে। এসেছেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালবাসাবশত। অর্থাৎ এঁরা শান্তিনিকেতন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ও মুগ্ধতা নিয়ে এসেছেন। আসার পরেও এই ২২ জনের কেউই শান্তিনিকেতনকে তাঁদের ভাল লাগেনি, এ কথা বলেননি। অর্থাৎ, ৬৫% শতাংশ পড়ুয়া যে শান্তিনিকেতনকে ভেবে এসেছিলেন এখানে পড়েত, তাঁদের সেই ধারণা মোটের উপরে অটুট আছে। কিছু দীর্ঘশ্বাস হয়তো জমেছে কারও, কারও মনে হয়েছে সময়ের সঙ্গে তাল রাখতে এই যে কিছু চ্যুতি, তা স্বাভাবিক।

আসি বাকি ১২ জনের কথায়। অর্থাৎ আমাদের সমীক্ষার ৩৫% ছাত্রছাত্রী। এঁরা শান্তিনিকেতনে এসেছেন শান্তিনিকেতন সম্পর্কে ঠিকমতো না জেনেই। কেউ বাড়ির বড়দের ইচ্ছায়, কেউ কেউ বা বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলে। কেউ বলেছেন বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করেন। একটি নিরাপদ আবাসিক প্রতিষ্ঠান তাঁদের দরকার ছিল। স্নাতক স্তরের এক ছাত্রী জানিয়েছেন, অন্য কলেজে ছাত্র-রাজনীতির দাপটে ভীত হয়েই অপেক্ষাকৃত রাজনৈতিক প্রভাব কম থাকাই তাঁর বিশ্বভারতীকে নির্বাচনের কারণ। দু-এক জন ছাত্র অকপটেই লিখেছেন সমীক্ষাপত্রে, বাড়ির নৈকট্য এবং হোম ইউনিভার্সিটির নম্বর প্রাপ্তির সুবিধা ছাড়া আর কোনও কারণ ছিল না বিশ্বভারতীতে পড়তে আসার। আবার দু’টি ভবনের দুই ছাত্রছাত্রীর কাছে জেনেছি, কাছাকাছি ওই দু’টি বিষযে ডিগ্রি করার আর কোনও প্রতিষ্ঠান নেই বলেই তাঁরা বিশ্বভারতীতে এসেছেন। তাঁদের লক্ষ্য কেরিয়ার গড়া। এই দ্বিতীয় দলের কাছে আমাদের সমীক্ষাপত্রে থাকা পরবর্তী প্রশ্নাবলি, যেমন শান্তিনিকেতন সম্পর্কে অনুভব, পূর্ব ধারণার সঙ্গে এখনকার কোনও পার্থক্য, ভবিষ্যতে শান্তিনিকেতনের জন্য কিছু করতে চাওয়ার ইচ্ছা আছে কিনা –এ সব প্রশ্ন অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। এঁদের বেশির ভাগের চোখেই শান্তিনিকেতনে এসে অনন্যতা বলতে চোখে পড়েছে শিক্ষকেদের ‘স্যর’ ‘ম্যাডাম’ না বলে ‘দাদা-দিদি’ বলে ডাকাটা।

অন্য ভাবনাও সামনে এসেছে সমীক্ষায়। আট বছর শান্তিনিকেতনে বাস করার পরে পূর্বপল্লী বয়েজ হস্টেলবাসী এক ছাত্র এখানে থাকার কোনও অর্থ খুঁজে পাননি। কেন তাঁর এ কথা মনে হয়, তার কোনও ব্যাখা তিনি না দিলেও তিনি জানিয়েছেন, তাঁর অভিভাবকেরা শান্তিনিকেতন সম্পর্কে ‘ভক্তিতে গদগদ’! আমরা অনুমান করতে পারি, শান্তিনিকেতনে আসার আগে এর অধিক প্রশংসা শোনা অথবা হয়তো ছোট বয়সেই অনিচ্ছার সঙ্গে হস্টেলবাসে বাধ্য হতে হওয়া তাঁর বিরক্তির কারণ হয়ে থাকতে পারে। অনেকটা পরিবারের ‘চাপাচাপাতেই’ শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ভূগোলের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী। তাঁকে আবার বিরক্ত করেছে, হস্টেলে নিয়মের বেড়াজাল। তিনি নিজেকে ‘খাঁচার পাখি’ লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি, হস্টেলে থাকলে তার নিয়মকানুন যে কড়া হবে এবং সেগুলো মানতেই হবে—সেগুলো এখানে আসার আগে তিনি বুঝতে পারেননি।

আমরা দেখলাম, যে-সব ছাত্রেরা পূর্ব ধারণা বা পূর্ব আবেগ নিয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, তাঁদের কাছে শান্তিনিকেতন এক রকম। আর পরিবারের কথায় বা হিসেব কষে এসেছেন যাঁরা, তাঁদের একাংশের কাছে শান্তিনিকেতন অন্যরূপ। ভালবেসে আসারা এখানে এসে পেয়েছেন শান্তির স্পর্শ, মনের মাঝে পেয়েছেন স্বপ্নপূরণের তৃপ্তি। একবিংশের এই শান্তিনিকেতন তাঁদের মোহভঙ্গ ঘটায়নি। বাস্তবে এসে তাঁদের গল্পে শোনা শান্তিনিকেতন হারিয়ে যায়নি, একুশের শান্তিনিকেতনও নবাগত তরুণ চোখকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। এটাই আমাদের শান্তিনিকেতন।
আসল শান্তিনিকেতন।

(লেখক বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে শান্তিনিকেতন বিষয়ক গবেষক এবং স্কুলশিক্ষিকা, মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Visva Bharat Shantiniketan Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE