Advertisement
E-Paper

যাদবপুর প্রশ্ন করতে শেখায়, তাই তাকে যক্ষপুরী বানানো চাই

এই সাহস একমাত্রিক নয়। বহু রং আছে, ধর্ম আছে তার। আছে ভাল-মন্দও। যা বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে নম্বরের অশ্লীল দৌড়ে জীবন নেই। জীবন পড়ে আছে যাদবপুরের বাইরেই।

রোহন ইসলাম

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৮ ০০:১২

কিশোর নন্দিনীকে বলেছিল, সমস্ত দিন সে কেবল সুড়ঙ্গে সোনার তাল খুঁড়ে তোলে। তার মাঝে যেটুকু সময় চুরি করে নন্দিনীর জন্য তার রক্তকরবীর ফুল খুঁজে আনা— সেটুকুতেই সে কেবল বেঁচে থাকে। এই ‘বেঁচে’ থাকার মধ্যেই ৪৭ফ কিংবা ৬৫ণ-এর মতো আর পাঁচ জন শ্রমিকের থেকে কিশোর আলাদা হয়ে ওঠে। সংখ্যা নয়, নন্দিনীর সামনে কিশোর তখন ‘বিশেষ’ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার টুকরো-মানুষের সত্তা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। সেই ভাঙনের সাহস আসে নন্দিনীর থেকেই।

নন্দিনীর মতোই আমাদের এই ঢেঁকিতে কুটে পিণ্ড হয়ে যাওয়া জীবনে সাহসের আর একটা নাম যাদবপুর। মাল্টিপল চয়েসের বন্ধ গড়ের ভিতরেও যে একখানা আকাশ বেঁচে আছে, সে কথা ভুলতে বসেছিলাম। ভুল ভাঙিয়েছিল যাদবপুর। সেই যাদবপুরে সাম্প্রতিক প্রবেশিকা-বিতর্ক কেবল একটি পরীক্ষা হওয়া বা না-হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ আদতে যাদবপুরের মাথা উঁচু করে থাকা সেই সাহসটাকেই দমিয়ে রাখার চেষ্টা। যা কিছু ভিন্ন, সংখ্যাগুরুর আধিপত্য তা মানতে পারে না। মানুষের পৃথক সত্তার বিকাশের পরিবর্তে খাপবন্দি অভিন্ন গোষ্ঠী গড়ার কলে তারা ফুঁ দিতে চায়। কিন্তু ভুলে যায়, তাতে আপদ আরও বাড়ে। নন্দিনীর স্পর্শে ৬৯ঙ-ও এক দিন স্পর্ধিত হয়ে ওঠে।

বীরভূমের এক মফস্সল স্কুল থেকে যাদবপুরের ৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেছিলাম। কোনও বাধা পাইনি। কোনও দাদাদিদিকেও ধরতে হয়নি। মদ-টাকা অফার করতে হয়নি। নির্বিঘ্নে ফর্ম তুলে জমা দিয়েছিলাম। ভর্তি হয়েছিলাম। একাই। কোনও দিনই ভর্তি নিয়ে দুর্নীতির কোনও অভিযোগ কখনও উঠেছে বা জমা পড়েছে— এমন অভিজ্ঞতাও হয়নি। এখানে এসে পড়ার আগে অবধি ছাত্রবন্ধু মুখস্থ করা মন কি কখনও নিজের কথা লিখে উঠতে পেরেছিল? ব্যবস্থার মধ্যেই সেই সুযোগটা ছিল না। বিপদে ফেলল যাদবপুর। এখানকার স্যর-ম্যাডামরা নিজের কথা না লিখলে নম্বর দেন না। উল্টে বইয়ের কথা লিখলে নম্বর কেটে নেন। ‘ঠিক লেখো বা ভুল— দুটোই যেন তোমার নিজের কথা হয়’— এর মতো আশ্চর্য শিক্ষা দেন তাঁরা!

পাঁচ বছরে কোনও টিউশন নিতে হয়নি। যা পড়েছি ক্লাসরুমেই। কোনও নোটস লাগেনি। একেবারে বানিয়েছি পরীক্ষার খাতায়। হোম আস্যাইনমেন্ট দিয়েছি। ওপেন বুক ইন্টারন্যাল অ্যাসেসমেন্টে বসেছি। এক সিমেস্টারে সংস্কৃত নাটক পড়েছি। আর এক সিমেস্টারে ফিল্ম স্টাডিজ়। বুঝেছি, ‘তাসের দেশ’-এ ক’টা চরিত্র আছে, সেই তথ্য স্মরণে রাখার মধ্যে কোনও এলেম নেই। যতটা আছে বেড়ার নিয়ম ভাঙার স্পর্ধার রহস্য উদ্‌ঘাটনে। ক্লাসরুমই হোক কিংবা বেঙ্গল ল্যাম্পের বাইরে নেপালদার চায়ের দোকান, হাজারো বিষয় নিয়ে স্যর-ম্যাডামদের সঙ্গে তর্ক জুড়েছি। মিলনদার দেওয়ালে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পোস্টার সেঁটেছি। পরক্ষণেই ছুটেছি নাটক দেখতে। সিলেবাসকেও যে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যায়, সেই সাহস জুগিয়েছে যাদবপুর।

এই সাহস একমাত্রিক নয়। বহু রং আছে, ধর্ম আছে তার। আছে ভাল-মন্দও। যা বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে নম্বরের অশ্লীল দৌড়ে জীবন নেই। জীবন পড়ে আছে যাদবপুরের বাইরেই। সেই ছাঁচে গড়া জীবনের বঞ্চনা, শোষণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করে যাদবপুরের রাজনীতিসচেতন মন্দ ছেলেমেয়েরা। সেই যাদবপুরে ক্যানিং লোকাল ধরে ক্লাস করতে আসা বাসন্তীর গ্রামের ছেলে আছে। আছে মডার্ন হাইয়ের মেয়েও। না, যাদবপুর এলিটদের আঁতুড়ঘর নয়। যাদবপুর আদতে ‘সংখ্যালঘু’। ক্রমশ কোণঠাসা। গোটা ব্যবস্থা এবং তার পপুলার রাজনীতি যার বখাটেপনাকে গিলে খেতে চায়। খাপবন্দি করে রাখতে চায়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও তবু সে লড়ে যায়। তাকে ধরে রাখা যায় না মাল্টিপল চয়েসে। ভর্তি নিয়ে রাজ্য জুড়ে গোলমালের গল্পেও।

যাদবপুর কি তা হলে বলতে চায় বোর্ডগুলোতে কোনও পড়াশোনা হচ্ছে না? এমনি এমনিই সেখানকার পড়ুয়ারা হিউম্যানিটিজ় থেকেও প্রথম হয়ে যাচ্ছে? প্রশ্নটা কোনও নির্দিষ্ট এক জনের ৯৯ শতাংশ নম্বর পাওয়া নিয়ে নয়। প্রশ্ন ব্যবস্থাটা নিয়ে। যাঁরা সেই ব্যবস্থায় পুঁজি জুগিয়ে চলেছেন, তাঁদের নিয়েও। পাশের হার এবং নম্বর বাড়ানোর দৌড়ে বোর্ডগুলো ক্রমশ তথ্যসর্বস্ব অতিসংক্ষিপ্ত মাল্টিপল চয়েসের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অথচ সারা দুনিয়ায় উচ্চশিক্ষায় হিউম্যানিটিজ় চর্চায় এই তথ্য বা তথ্যের স্মৃতির কোনও গুরুত্বই নেই। আবার আর্টস-সায়েন্স-ইঞ্জিনিয়ারিং— সব ক’টা বিষয়েই যদি এক ছাঁচে গড়া সাধারণ কোনও ব্যবস্থায় পড়ুয়ার মেধার বিচার করা শুরু হয়, সেটাও কি যথাযথ হবে? প্রতিটি বিষয়ের নিজস্ব কিছু চাহিদা আছে। গণিতের এক রকম, তুলনামূলক সাহিত্যের আর এক রকম। একই ছাঁকনি দিয়ে সেই চাহিদার বিচার করা যায় না। কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও জরুরি বিষয়। আর বোর্ডগুলোর বর্তমান শিক্ষা নীতি যেন সেই কল্পনার ক্ষমতাকেই ছেঁটে ফেলতে চায়। কিন্তু যাদবপুর? ‘ওরা যত বেশি পড়ে/ তত বেশি জানে/ তত কম মানে’। প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তরপত্রের পাতায় পাতায় এই প্রত্যয়ের ছাপটুকুই খোঁজে যাদবপুর।

মুশকিলটা হল, বিশু পাগলদের ৬৯ঙ করে রাখার এই খেলা চলছে দেশ জুড়েই। উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির হার হতাশাজনক। বিভিন্ন গবেষণামূলক কেন্দ্র, স্কুলগুলোর ফান্ড কমে যাচ্ছে। গবেষণার জন্য পড়ুয়াদের পিছনে টাকা ঢালতে নারাজ কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘স্বাধিকার’ দেওয়ার নামে শিক্ষাকে কার্যত ব্যক্তিগত পুঁজিনির্ভর প্রতিষ্ঠান করার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আবার দেশ জুড়ে স্কিল-নির্ভর অভিন্ন ‘সিবিসিএস’ চালু করে উচ্চশিক্ষার মৌলিক দর্শনের ভিতকে ভোঁতা করে দেওয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, ইউজিসি-কে তুলে দিয়ে ‘হায়ার এডুকেশন কমিশন অব ইন্ডিয়া’ গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ‘দায়’টাই ঝেড়ে ফেলার পথ প্রশস্ত করছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। প্রতিটি সিদ্ধান্তই আদতে এ দেশের উচ্চশিক্ষায় মুক্তচিন্তার চর্চাকে এক পণ্যসর্বস্ব খাদের ধারে টেনে আনার চেষ্টা। আর এখানেই কোথাও যেন এক হয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্য। প্রায় সব ক’টি পদক্ষেপের লক্ষ্য একটাই: ছাত্রসমাজের প্রশ্ন করার অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়া। কারণ, জেএনইউ-ই হোক বা যাদবপুর— দু’দলই জনপ্রিয় আখ্যানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দশ-পঁচিশের ছকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানকে নাগাড়ে প্রশ্ন করে। আর তখনই কেউ অ্যান্টি-ন্যাশনাল, তো কেউ মাওবাদী হয়ে যায়। এর ফলে দেশ জুড়ে লিবারাল ও সেকুলার, গণতন্ত্রের এই দুই ভিতই বিপন্ন হচ্ছে।

ক’দিন আগেই টাসমানিয়ার এক পিতার একটি টুইট ভাইরাল হয়েছিল। স্কুলের পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড বাড়িতে এনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল তাঁর ন’বছরের অটিজ়ম-আক্রান্ত কন্যা সোফি। বাবাকে বলেছিল, ‘‘আই হ্যাভ লেট এভরিওয়ান ডাউন।’’ বাবা তখন মেয়ের খাতায় একটি নতুন রিপোর্ট কার্ড বানিয়ে দেন। সোফি কতটা মজার মেয়ে, কুকুরদের কেমন ভালবাসে, ছেলেদের সঙ্গে কেমন লড়ে, তার আঁকা ও কল্পনার ক্ষমতা কেমন, এমন নানা বিষয়ে মেয়ের মূল্যায়ন করে দেন। সেই রিপোর্ট কার্ডই ছোট্ট সোফিকে লড়াই করার ক্ষমতা জুগিয়েছে। ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েগুলোর জন্য এমন রিপোর্ট কার্ড পাওয়ার সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে যাদবপুর। আইনি ফাঁকের অজুহাতে এমন একটি ব্যবস্থাকে দুম করে বাতিল করে দেবেন? এই ভীষণ যক্ষপুরীর মধ্যে কিশোরদের বেঁচে থাকার আলোটুকু কেড়ে নিলে আর কী-ই বা পড়ে থাকে!

Education Student
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy