Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
India

সীমান্তের দু’পারেই পাকিস্তান

কবরে শুয়ে হয়তো হাসছেন পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্না।

মিলন হালদার
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আপনি ভাত চান। চাকরি চান। আইনের শাসন চান। দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি চান। আপনাকে তা হলে যেতে হবে পাকিস্তানে!

ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আপনি ভোট দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছেন। কিন্তু মোদী-শাহেরা এখন পাকিস্তান বিরোধিতার কাজে ব্যস্ত। দয়া করে এখন কেউ ভাত-চাকরির আবদার করে বিরক্ত করবেন না। এ সব আবদারের অর্থ, আপনি ‘পাকিস্তানের সুর’-এ কথা বলছেন। আরএসএস-বিজেপির বড়-মেজো-সেজো নেতারা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, নেতারা যা বলছেন, তার থেকে ‘অন্য রকম’ কিছু বললেই ‘দেশদ্রোহী’দের চলে যেতে হবে শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তানে।

কবরে শুয়ে হয়তো হাসছেন পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্না। পাকিস্তান-বিরোধিতা এবং তার অঙ্গ হিসেবে যে কোনও বিরোধী স্বরকে পাকিস্তানে পাঠানোর হুমকি দিতে দিতে যে মোদী-শাহের ভারতও ক্রমশ হয়ে উঠছে দ্বিতীয় পাকিস্তান!

অনেকে অনেক সময়ে প্রশ্ন তুলছেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে এক সঙ্গে পথ চলা শুরু করা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কি তত বড় ফারাক ছিল কখনও? ছিল। একটি মৌলিক ফারাক ছিলই— যার নাম গণতন্ত্র। ভারতের গণতন্ত্রই তাকে পাকিস্তানের থেকে আলাদা করেছিল। পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করত ধর্ম এবং সেনা। উল্টো দিকে, হাজার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, ধর্মনিরপেক্ষ বা উদারবাদের নানা খামতি সত্ত্বেও, কেবল গণতন্ত্রের অনুশীলনই ভারতকে এক আলাদা রকম রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। যা আমাদের শিখিয়েছিল, খারাপ ভাল যা-ই হোক, ভারত হিন্দু বা মুসলমানের দেশ নয়, প্রতিটি ভারতবাসীর দেশ।

এটা ঠিক যে এখনও শিক্ষায়-অর্থনীতিতে ভারতীয় মুসলিমেরা অনেকখানি পিছিয়ে। এতগুলি বছর একসঙ্গে থাকার পরেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিশ্বাসের ভিতটি ততটা মজবুত নয়। এখনও হিন্দু পাড়ায় কোনও মুসলিম ঘরভাড়া পান না। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণেই এত দিন মুসলিমদের নাগরিকত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। ভারতে কেউ তাঁদের অবাঞ্ছিত মনে করেননি। ভারতের মাটিতে তাঁদের ঘাম-রক্ত মিশে থাকার কথা কেউ অস্বীকার করেননি। মুসলিমদের দেশহীন করার জন্য রাষ্ট্র উঠেপড়ে লাগেনি। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এনে মোদী-শাহ ঠিক সেই কাজগুলিই করতে শুরু করেছেন। সিএএ-এনআরসি দেশের একটা বড় অংশের সমর্থন পেয়ে যাওয়ার পর ভারতের চরিত্র সেই জন্যই পাল্টে যেতে শুরু করেছে। সেটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।

ভারত-পাকিস্তানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল গণতন্ত্রের যে দেওয়ালটি, তাতে ফাটল ধরানোর কাজ অবশ্য বিজেপি-আরএসএস অনেক আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছে। সব দিক দিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামাটাই তো ভারতের ফাটল ধরানোর সবচেয়ে সহজ পথ। পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের খুন করা হয়, তাই ভারতে গো-মাংস খাওয়ার ‘অপরাধ’-এ বা গরু চোর সন্দেহে সংখ্যালঘু মুসলিমদের পিটিয়ে মারা শুরু হল! পাকিস্তানে হিন্দুদের দেশ থেকে চলে যেতে বলা হয়; তাই ভারতে মুসলিম এবং বিরোধী-সমালোচকদের দেশছাড়া করার হুমকি দেওয়া শুরু হল! পাকিস্তানে হিন্দুকে মুসলিম বানানোকে বলা হয় বর্বরতা, আর ভারতে মুসলিমকে হিন্দু বানানোকে নাম দেওয়া হয় ‘ঘর ওয়াপসি’। পাকিস্তানে মন্দির ভাঙা হলে ছি-ছি করা হয়, ভারতে মসজিদ ভাঙা হলে— কেয়া বাত, জাতীয়তাবাদ!

নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ ভালই জানেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অর্থ, রাষ্ট্র সব ধর্মের থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখবে, রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় কাজ থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন রাখবে, প্রতিটি নাগরিকের ধর্মাচরণ করার এবং না করার অধিকার সুনিশ্চিত করবে। অর্থাৎ কোনও দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা হল আবশ্যিক একটি শর্ত। কিন্তু যে মুহূর্তে নাগরিকত্বের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল ধর্মকে, মুসলিমদের বুঝিয়ে দেওয়া হল মোদী-শাহের ভারতে তাঁরা অবাঞ্ছিত, ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে খুন হল গণতন্ত্রও। ধসে গেল পাকিস্তানের সঙ্গে পার্থক্যের দেওয়াল।

তাই বলছিলাম, ভারতেও যদি গণতন্ত্রের গঙ্গাযাত্রা হয়ে যায়, ভারতও যদি পাকিস্তান হয়ে যায়, তা হলে অপছন্দের ভারতীয়দের আর পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন কেন নেতারা? একটা কারণ আছে অবশ্যই। তা হল, বর্ডারের ও দিকের পাকিস্তান মুসলিম পাকিস্তান। আর বর্ডারের এ দিকে এখন, এই দেশ হয়ে উঠতে চাইছে হিন্দু পাকিস্তান!

এই সেই দেশ, যেখানে পেটে ভাত না থাক, চাকরি না থাক, আইনের শাসন না থাক, রামমন্দির থাকবে, রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য থাকবে। গরু থাকবে। গরুর মূল্য হবে মানুষের থেকেও বেশি!

কবরে শুয়ে জিন্নারা হাসছেন। পাকিস্তান যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁদের সম্পূর্ণ জয় হল এত দিনে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Pakistan CAA NRC Narendra Modi BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE