Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Politics

সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যায়?

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ভোট বাড়ে কি না, বাড়লেও কী ভাবে বাড়ে, তা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্ন।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২০ ০১:০১
Share: Save:

অন্য রাজ্য থেকে আসা এক ছাত্র গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বলেছিল, ভোটের আগে কৃষি-ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি আসবেই, না হলে বহু চাষিকে আত্মহত্যা করতে হবে। ঋণ মকুবের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আসবে ধরে নিয়ে অনেকেই নাকি ঋণের টাকা নানা ভাবে খরচ করে ফেলেন। তবে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তো আর শুধুমাত্র কৃষিঋণ মকুবে আটকে থাকে না। দু’টাকা কিলো দরে চাল, পরিকাঠামো বাড়ানো, সামাজিক ন্যায়, বিদেশনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ দূষণ বা জলবায়ুর বিপর্যয় আটকানো, সবই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিষয় হতে পারে।

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ভোট বাড়ে কি না, বাড়লেও কী ভাবে বাড়ে, তা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্ন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিশ্রুতির পরিমাণের সঙ্গে ভোটের সম্পর্কের রেখচিত্র উল্টানো ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো। একটা সীমা পর্যন্ত প্রতিশ্রুতির বহর বাড়লে ভোট বাড়ে। তার পর প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতা কমে, ভোটও কমতে থাকে। আসলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের কোনও আইনগত দায় নেই। করদাতাদের টাকায় কোনও প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেওয়াতেও কোনও বাধা বোধ হয় নেই। যেটা থাকে তা হল নির্বাচকদের কাছে প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার নির্বাচনী দায়। কোন দল কতখানি সত্যি বা বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেটা শেষ কথা নয়। যারা নিজেদের বক্তব্য বেশি সংখ্যক মানুষকে বোঝাতে পারবে, নির্বাচনের পাল্লা তাদের দিকেই ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা।

দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কতটা পালন করে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি? গবেষকরা অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো মোটের উপর তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে চেষ্টা করে। ১৯৪৪-৭৮ সময়সীমায় আমেরিকায় পালন করা হয়েছে ৬০% নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। মোটামুটি একই সময়সীমায় ব্রিটেন, কানাডা, গ্রিসের মতো দেশে এটা ৭০-৮০%। ১৯৭৪-৯৭ সময়কালে ব্রিটেনে এই শতাংশটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫। ২০১৭-তে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রেও ইউরোপের ১১টি দেশ এবং আমেরিকার প্রেক্ষিতে দেখানো হয়েছে যে, রাজনৈতিক দলগুলি তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করে বেশ ভাল মাত্রায়। ভারতের পটভূমিকায় এমন কোনও তথ্যভিত্তিক গবেষণা থাকলেও তা আমার চোখ এড়িয়েছে।

প্রতিশ্রুতি ভাঙার বিস্তর গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণও অবশ্য রয়েছে, দেশে দেশে, এবং তা দলমত-নির্বিশেষেই। ১৯৮৮-র আমেরিকার নির্বাচনের প্রেক্ষিতে জর্জ বুশ সিনিয়র প্রতিশ্রুতি দেন তাঁর কার্যকালে কর না বাড়ানোর। কথা রাখেননি। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে বারাক ওবামা বার বার প্রতিশ্রুতি দেন কিউবার গুয়ান্টানামো বে-র ডিটেনশন ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়ার— তাঁর আট বছরের শাসনকালে করতে পারেননি।

অতিমারি-বিধ্বস্ত দুনিয়ায় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও যে খানিক ভিন্ন খাতে বইবে, তাতে আর সন্দেহ কী! সদ্যসমাপ্ত নিউ জ়িল্যান্ডের নির্বাচনে পুনর্নিবাচিত হয়ে আসা জেসিন্ডা আর্ডের্নের লেবার পার্টির নির্বাচনী ইস্তাহারের ‘হৃদয় জুড়ে’ও সেই কোভিড মুক্তির সুর। করোনাভাইরাসের প্রকোপে কাজ হারিয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। কর্মসংস্থানের কম-বেশি প্রতিশ্রুতি নির্বাচনের আগে এমনিতেই দেওয়া হয়, আর এই সময়ে সেই প্রতিশ্রুতি একটু বেশিই গুরুত্ব পাচ্ছে। আবার কোভিডের সম্ভাব্য টিকাকে মানুষ সুস্থ জীবনযাপনের ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র হিসেবে ভাবতে জেনেছে। করোনাকালে টিকা নিয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তাই এক প্রকার অনিবার্যই ছিল। বিহার হোক, বা আমেরিকা— ভোটে জিতলে বিনি-পয়সায় টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে তাই অবাক হওয়ার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। দক্ষিণপন্থী বিজেপি থেকে আমেরিকার সামাজিক উদারপন্থায় বিশ্বাসী মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাট দল পর্যন্ত করোনাকালে টিকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সকলের জন্য। ক’মাস পরের পশ্চিমবঙ্গেও এক বা একাধিক রাজনৈতিক দল যদি এমন প্রতিশ্রুতি না দেয়, বেশ অবাক হব।

ভেবে দেখলে, কৃষিঋণ মকুব কিংবা দু’টাকা কিলো দরে চালের চাইতে বিনি-পয়সার টিকা কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মুশকিল হল, সবাই আশা করছে, টিকা আসছে অদূর ভবিষ্যতে। সত্যিই তেমন কোনও কার্যকর টিকা আদৌ আসবে কি না, এলেও তা কবে, সে সব তো একেবারেই অজানা। আবার সেই টিকার ক’টা ডোজ় দরকার হবে, পরে কোনও বুস্টার ডোজ় লাগবে কি না, এমনকি প্রতি বছর টিকা নিতে হবে কি না, এবং সে ক্ষেত্রে তার কতটা এই সব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির আওতায় পড়ল, সে বিষয়েও অস্পষ্টতা থাকবেই। ভারতে, আমেরিকায়, অন্যত্র।

এক বিমূর্ত সম্ভাব্যতা নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির বিষয়বস্তু হয়ে ওঠাও মনে হয় ‘নিউ নর্মাল’ ভোটের সংস্কৃতিরই অঙ্গ।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE