বিতর্কিত: পুরনো দলে ফিরে আসার পর তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মুকুল রায়।
ভোটে পর্যুদস্ত বিজেপি থেকে ‘ঘরমুখী’ যে উল্টো স্রোত এখন বিজয়ী তৃণমূলের দিকে ধাবিত, রাজ্য-রাজনীতিতে তা আগামী দিনে অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে পারে। তৃণমূলে তাঁদের ক’জন কী ভাবে জায়গা পাবেন, দলের সাধারণ কর্মীদের আপত্তি সেই বিবেচনায় মান্যতা পাবে কি না, সে সব ভবিষ্যৎ বলবে। তবে, এই ধরনের প্রবণতা বাংলার রাজনীতিতে একটি ভয়ঙ্কর, নেতিবাচক ধারা চিহ্নিত করে, যার মূল দায় বিজেপি এড়াতে পারে না।
বিধানসভা ভোটে ‘জয়ের কৌশল’ ঠিক করতে বসে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব খোলাখুলি বলেছিলেন, ক্ষমতায় যেতে হলে যে ভাবে হোক দল বাড়াতে হবে। সেই জন্য ভোটের মুখে তৃণমূল ভাঙানো ছিল তাঁদের সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দল আদাজল খেয়ে সেই কাজে নেমে পড়েছিল।
দল ভাঙার রাজনীতি রাজ্যে অভিনব নয়। তৃণমূল কংগ্রেসও করেছে। কিন্তু দুয়ারে ভোট আসতেই লোভী শৃগালের সামনে টোপ ঝুলিয়ে আঙুর খেতের বেড়া ভেঙে দেওয়ার মতো এমন খুল্লমখুল্লা ঘটনা অতীতে ঘটেনি। বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি সেই চক্ষুলজ্জাহীনতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এর কুপ্রভাব সুদূরপ্রসারী হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ, আজ এক দল করেছে, কাল হয়তো অন্য দল করবে। নজির তো গড়াই রইল!
একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, বিজেপি যদি ভোটে জিতে যেত, ক্ষমতালোভী, সুযোগসন্ধানী মুখগুলি কিন্তু তখন ‘অনুশোচনায়’ দগ্ধ হতেন না। বরং মনে করতেন, তাঁরা ‘ধর্মযুদ্ধে’ জিতেছেন। ফল বিপরীত হয়েছে বলেই আজ পরাজিতদের এত কাতর ক্রন্দন! দল যা-ই হোক, আসলে এঁরা সবাই ‘রাজনীতিক’!
মুকুল রায়কে অবশ্য এই তালিকায় ফেলা ঠিক নয়। তিনি তৃণমূলে ফেরার পর থেকে গত কয়েক দিনে জল অনেক গড়িয়েছে। কিন্তু এ কথা বলতে হবে, তাঁর তৃণমূল-ত্যাগ এবং প্রত্যাবর্তন, দুয়েরই প্রেক্ষাপট কিছুটা আলাদা।
প্রায় চার বছর বিজেপির ঘর করার পরে মুকুলবাবুর প্রত্যাবর্তন তৃণমূলকে কতটা বাড়তি শক্তি জোগাবে, নব সাজে সজ্জিত তৃণমূলে তিনি নিজে এই পর্বে কতটা মানানসই হয়ে উঠবেন— এই সব প্রশ্ন স্বাভাবিক। সেই আলোচনা অবশ্যই হবে।
মুকুল-খসা বিজেপির প্রতিক্রিয়ার বহরে মনে হচ্ছে যেন তাঁর মতো ‘অযোগ্য, অস্বচ্ছ, অদক্ষ’ এক জন লোকের বোঝা এত দিন বৃথাই বয়েছে এই দল। কিন্তু মুকুল ‘ঝরার’ পরে বিজেপির হাল দেখে আরও যে সব প্রশ্ন সামনে এসেছে, আগে সেগুলির উত্তর খোঁজা জরুরি। কারণ, তার সঙ্গে রাজ্যের এখনকার রাজনীতি থেকে শুরু করে আগামী দিনের বিবিধ সম্ভাব্যতার আভাস জড়িয়ে রয়েছে।
প্রথমেই বলি, মুকুল রায় ভাল বা মন্দ, সৎ বা অসৎ, মিরজাফর বা সিরাজউদৌল্লা, সেই বিতর্ক নতুন কিছু নয়। তার মীমাংসা যেখানে যে ভাবে হবে, হোক; এখানে আলোচ্য হল, এক জন ব্যক্তির রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং তাকে কেন্দ্র করে একটি ‘সুসংবদ্ধ’ দলের স্ববিরোধী চরিত্র।
মুকুলবাবু বিজেপিতে যোগ দেন ২০১৭ সালে। তার কিছু দিন আগে থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বোঝা গিয়েছিল। এমনকি ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি তৃণমূলে আগের মতো ‘সক্রিয়’ ছিলেন না।
কিন্তু, এখন মুকুল রায় বিজেপি-সঙ্গ ত্যাগের পরে বিজেপির নানা কথা ও কার্যকলাপ থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝতে একটু ‘সমস্যা’ হচ্ছে! যেমন সবার আগে বোঝা দরকার, তাঁকে বিজেপি নিয়েছিল কেন? প্রশ্নটি তোলার কারণ, যখন মুকুলবাবু বিজেপিতে যান তখন সারদা, নারদ মামলা সামনে চলে এসেছে।
সে ক্ষেত্রে মুকুলবাবুকে ‘কলঙ্কিত’ জেনেও যদি বিজেপি তাঁকে দলে নিয়ে থাকে, তা হলে বিজেপি নেতাদের আজ ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে স্বীকার করতেই হবে, সব জেনেবুঝে তাঁরা আরও বড় কোনও স্বার্থের অঙ্ক কষে তাঁকে দলে নিয়েছিলেন। সেখানে অন্য কোনও বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন দল বোধ করেনি।
এরও অবশ্য একটি বাঁধা গতের জবাব আছে। বিপাকে পড়লে সব দলই যা বলে। বিজেপির উপরওয়ালারাও বলেছেন, “আইন আইনের পথে চলবে।” কিন্তু রাজনীতিতে এই বাক্যটি যে কত বড় ভাঁওতাবাজি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুকুলবাবুকে সিবিআই, ইডি-র জুজু দেখানো হয়েছিল কি না, সেটা তর্কসাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু তাঁর প্রয়োজনীয় ‘যোগ্যতা’ আছে বুঝেই যে বিজেপি তাঁকে সাদরে বরণ করেছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই আজ যদি তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া ফের জিইয়ে ওঠে, তা হলে সেটাও অর্থপূর্ণ হতে বাধ্য। তবে এ বার তাঁকে একা ধরা মুশকিল হতে পারে। কারণ, একই যুক্তিতে আঙুল উঠতে পারে বিজেপির অন্য নেতার দিকেও।
বিধানসভা ভোটের সময় তৃণমূল ভেঙে আসার যে ঢল দেখা গিয়েছে, তার সঙ্গেও মুকুল রায়ের বিজেপিতে যোগদানের বাস্তব কিছু ফারাক আছে। তিনি যখন পদ্ম-শিবিরে যান, তখন সেখানে পাইয়ে দেওয়ার গরমাগরম হাতছানি ছিল না। কারণ, লোকসভা ভোট তখনও বছর দুয়েক দূরে, বিধানসভা ভোট চার বছর। ফলে তাঁর দিক থেকে নিজের রাজনৈতিক মুনশিয়ানা প্রমাণ করার কিছুটা দায় ছিলই।
মুকুলবাবু তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার পরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য বলেছেন, “ওঁকে নিয়ে আমাদের লাভ কিছু হয়নি।” কিন্তু প্রশ্ন, ২০১৮-র পঞ্চায়েত এবং ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মুকুল রায়কে তা হলে উপর্যুপরি বিজেপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছিল কেন? কেনই বা গত লোকসভা ভোটে বিজেপি ১৮টি আসনে জেতার পরে এই ব্যক্তিকেই ‘ধন্য, ধন্য’ করেছিলেন বিজেপির শীর্ষনেতারা? গত বছর মুকুলবাবুকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করা কি তারই এক স্বীকৃতি ছিল না?
সহ-সভাপতি হয়ে মুকুলবাবু কতটা কী কাজের পরিসর পেয়েছিলেন, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। এটা দেখা গিয়েছে, অন্য সহ-সভাপতিদের যেমন নির্দিষ্ট ভাবে কোনও না কোনও দায়িত্ব থাকে, মুকুলবাবুর তেমন কিছু ছিল না। তবে সে সব ওই দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
এ বারের বিধানসভা ভোটেও মুকুল সে ভাবে প্রস্ফুটিত বলে মনে হয়নি। বরং কিছুটা আবডালেই ছিলেন মুকুল রায়। বস্তুত, এ বার বিজেপির রাজ্যস্তরে কোনও নির্বাচন পরিচালনা কমিটিই করা হয়নি। ভোটের সব কিছু ‘নিয়ন্ত্রিত’ হয়েছে দিল্লি থেকে।
দিল্লিই মুকুল রায়কে বিধানসভায় প্রার্থী করে। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে এমন একটি আসন দেওয়া হয়, যেটি বিজেপির পক্ষে আদৌ কঠিন ছিল না। তৃণমূলও সেটা মানত। সেখান থেকে জিতে মুকুলবাবু জীবনে প্রথম বিধায়ক।
তা হলে ধরে নিতে হবে, মুকুলবাবুকে বিজেপি জিতিয়ে আনতেই চেয়েছিল। যদি দলে তাঁর ‘প্রয়োজন’ না-থাকত, তা হলে এটা করা হত বলে মনে করি না। আবার ভোটে জেতার পরে যিনি দল ছাড়লেন, তাঁকে ক্ষমতালোভী বা সুযোগসন্ধানী বলা কত দূর সমীচীন, তা-ও বিচার্য।
নতুন চেহারার তৃণমূলে মুকুলবাবুকে নিশ্চয় একটি পদ দেওয়া হবে। তবে তিনি বিশাল কোনও দায়িত্ব পাবেন, এমনটা না-ও হতে পারে। বস্তুত, তিনি যখন দল ছেড়ে গিয়েছিলেন, তখনকার সাংগঠনিক কাঠামো ও তাঁর পদাধিকার কিছুই আগের মতো নেই। থাকার কথাও নয়।
তবু ভোটে জিতেও তাঁর এই দলবদলের সিদ্ধান্তে মনে হয়, বিজেপিতে সম্ভবত তাঁর দিন ফুরিয়েছিল। মুকুলবাবু জানিয়েছেন, তিনি কেন বিজেপি ছেড়ে এলেন, সেই বৃত্তান্ত পরে বলবেন। অপেক্ষা তাই জারি আছে।
বাকিটা সময় বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy