কলকাতা হাই কোর্টে পর পর কয়েকটি ঘটনায় দলীয় রাজনীতির সংঘাতের যে প্রকাশ ঘটল, তা আইনজীবীদের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা আইনজীবী পি চিদম্বরম একটি ডেয়ারি কোম্পানির পক্ষে সওয়াল করতে এসেছিলেন। ওই সংস্থা তথা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী। রাজ্য সরকারের অধীন মেট্রো ডেয়ারি হস্তান্তরে দুর্নীতি হয়েছে, এই অভিযোগে অধীরবাবু তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরকার ও অধিগ্রহণকারী ডেয়ারি সংস্থা কেভেন্টার্সের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন। কংগ্রেস এই বিষয়ের মধ্যে কোনও ভাবেই জড়িত ছিল না। তা সত্ত্বেও কিছু আইনজীবী প্রকাশ্য আদালতে চিদম্বরমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালেন। চিদম্বরম কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা হয়েও অধীরবাবুর বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের পক্ষে মামলা লড়ছেন কেন, এই তাঁদের ক্ষোভ।
এই ঘটনায় কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবীদের মর্যাদা অন্যান্য রাজ্যের কাছে ক্ষুণ্ণ হল না কি? বিশেষত আইনজীবীরা যে ভাবে নিজেদের গাউন খুলে সেগুলিকে ঝান্ডার মতো ব্যবহার করলেন, তা মেনে নেওয়া কঠিন। মক্কেলকে আইনি সহায়তা দেওয়াই আইনজীবীর প্রধান কাজ। তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী, সাংসদ বা বিধায়ক হলেও, পেশার ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান কখনওই বড় হয়ে উঠতে পারে না। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তৃণমূল-পরিচালিত রাজ্য সরকারের সপক্ষে মামলা করতে নিষেধ করেনি চিদম্বরমকে। তা হলে তাঁর দোষ কোথায়? কেনই বা কোনও একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী আইনজীবী অন্য আদর্শের অনুগামী ব্যক্তি, বা সংস্থা, বা নির্বাচিত সরকারের হয়ে মামলা করতে পারেন না? কলকাতা হাই কোর্টে রোজই দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাংসদ বা সমর্থক হয়েও সেই দলের বাইরে অন্য মতাদর্শের মক্কেলের স্বার্থে মামলা লড়ে যাচ্ছেন। আইনজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার কথা হাই কোর্টের আইনজীবীদের অজানা তো নয়।
একই প্রশ্ন আরও তীব্র ভাবে উঠে এল বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছু আইনজীবীর আচরণে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় ডিভিশন বেঞ্চের সঙ্গে তাঁর সিঙ্গল বেঞ্চের মতানৈক্যের প্রতি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাতে ক্ষোভ প্রকাশ শুরু করে এ রাজ্যের শাসক দলের অনুগামী আইনজীবীরা। এজলাস বয়কটের সিদ্ধান্তে মতবিরোধের জেরে বার অ্যাসোসিয়েশনের সভায় নজিরবিহীন ভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি হল আইনজীবীদের মধ্যে। এজলাসের বাইরে ঘেরাও করে বিক্ষোভরত আইনজীবীরা এমন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করলেন যে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলতে বাধ্য হলেন, “মাথায় বন্দুক ধরতে পারেন।... কিন্তু দুর্নীতি দেখলে চুপ করে থাকব না। আওয়াজ তুলবই।” এই ঘটনায় এ রাজ্যের আইনজীবীদের ভাবমূর্তির মস্ত ক্ষতি হয়েছে। বিচারপ্রার্থীরা ফোন করে বলেছেন, “এঁদের মাধ্যমেই কি আমরা বিচার চাইতে যাব?”