Advertisement
০৪ জুন ২০২৪
পুনরুত্থান ঘটাতে গেলে অন্যান্য দলের সমর্থন আবশ্যিক
Congress

তবু কংগ্রেসের বিকল্প নেই

রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা নিয়ে মশগুল থাকতে পারেন, কিন্তু বিভক্ত ভারতকে অনায়াসে জুড়তে পারেন, এমন নেতা কংগ্রেসে এ মুহূর্তে কেউই নেই।

স্বদেশ: ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রায় কেরলের রাস্তায় রাহুল গান্ধী। পিটিআই

স্বদেশ: ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রায় কেরলের রাস্তায় রাহুল গান্ধী। পিটিআই

প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৫৭
Share: Save:

১৯৯৭ সালে সুদীর্ঘ আঠারো বছরের খরা কাটিয়ে লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় এনে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, মানুষ একটি রাজনৈতিক দলকে তখনই ক্ষমতায় আনেন, যখন তাঁরা দেখেন যে, ক্ষমতায় না থেকেও দলটিকে অমিত ক্ষমতাশালী মনে হচ্ছে। আদর্শগত ভাবে অবস্থান যা-ই হোক না কেন, জনমানসে ভাবমূর্তি দুর্বল হলে কোনও দলের পক্ষেই ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। ভারতের কংগ্রেস এবং ব্রিটেনের লেবার পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক সাযুজ্য কম নয়। দু’দেশেই উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ, কিছুটা সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে থাকা মানুষদের অন্যতম পছন্দ এই দু’টি রাজনৈতিক দল। অথচ, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই দু’টি দল কেন নিজেদের দেশে ক্রমেই জমি হারিয়ে চলেছে, তা খুঁজতে গেলে টোনি ব্লেয়ারের কথাটি মনে পড়তে বাধ্য। লেবার পার্টির বর্তমান নেতা কেয়ার স্টার্মার সে কথা উপলব্ধি করেই গত এক বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলির থেকেও অনেক বেশি বক্তব্য পেশ করেছেন দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশ্নগুলি নিয়ে। জনপরিসরে ভাবমূর্তিই যদি শেষ কথা হয়, তা হলে ইংল্যান্ডের পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, লেবার পার্টি ২০২৪-এর নির্বাচনে জিতে প্রায় চোদ্দো বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসতেই পারে। কিন্তু, কংগ্রেসের কি সে সম্ভাবনা আদৌ আছে?

রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা নিয়ে মশগুল থাকতে পারেন, কিন্তু বিভক্ত ভারতকে অনায়াসে জুড়তে পারেন, এমন নেতা কংগ্রেসে এ মুহূর্তে কেউই নেই। খতিয়ে দেখলে অবশ্য বোঝা যাবে, এ সমস্যা আজকের নয়। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস ক্ষমতা হারিয়েছে তেত্রিশ বছর আগে; গুজরাতে সাতাশ, পশ্চিমবঙ্গে পঁয়তাল্লিশ, তামিলনাড়ুতে পঞ্চান্ন বছর ধরে একক ভাবে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারেনি। অর্থাৎ, এক বার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে কংগ্রেসের ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এই ঘটনাপ্রবাহ প্রায় নিয়মে পর্যবসিত। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী বা নরেন্দ্র মোদীদের মতো রাজনৈতিক ক্যারিসমা-সম্বলিত নেতা না থাকলে কি একটি রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার? এর উত্তর দিতে পারেন আমেরিকার জোসেফ বাইডেন ও জার্মানির ওলাফ শোলৎজ়। তাঁদের পূর্বসূরি, অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্প বা আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এঁদের কারও নেই। অথচ, দু’জনেই জোট রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে নির্বাচন বৈতরণি পার হয়েছেন। এঁদের কেউ পুরোদস্তুর বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, অথচ এঁরা হয় বামপন্থী রাজনৈতিক দল, অথবা নিজেদের দলের বামপন্থী সদস্যদের পূর্ণ সমর্থন আদায়ে সফল হয়েছেন। একই পথ অবলম্বন করে সনিয়া গান্ধী ২০০৪ সালে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় এনেছিলেন, বিজেপির প্রত্যাবর্তনের পূর্বাভাস ব্যর্থ করে। আসলে ভিন্ন মতাদর্শের দলগুলিকে এক সঙ্গে নিয়ে চলতে পারাটাও ভোটারদের জন্য একটা বড় সঙ্কেত— এই নেতা পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ, যাঁর উপর আস্থা রাখা যেতে পারে। যে রাহুল গান্ধী নিজের দলের সাংসদ বা নেতাদেরই সময় দিচ্ছেন না, তিনি জোটধর্ম পালনে কতটা সফল হবেন, সে বিষয়ে মানুষের সংশয় থাকা স্বাভাবিক। আবার এ কথাও অনিবার্য সত্য যে, বামপন্থী এবং সমাজবাদী দলগুলির প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া কংগ্রেসের ক্ষমতায় ফেরার কোনও রাস্তা খোলা নেই।

২০০৪ সালের তুলনায় বামপন্থীদের ক্ষমতা নিশ্চিত ভাবেই বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু কেউ বলতেই পারেন যে, বামপন্থীদের ভাগ্যের চাকা ফের ঘুরবে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা, এই দু’রাজ্যেই ক্রমাগত দুর্নীতি এবং অপশাসনের ফলে মানুষ শাসক দলের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন। এর প্রভাব রাজ্য নির্বাচনে কতটা পড়বে, তা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু বামপন্থীরা যে তুলনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এই কারণেই কংগ্রেসের উচিত বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতায় যাওয়া।

কংগ্রেস যে মূলগত ভাবে পরিবারতান্ত্রিক, তা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু ভারত এমন একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যে, পরিবারতন্ত্র নামক বিচ্যুতিকে আপাতত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। যে কারণে শশী তারুর বা মল্লিকার্জুন খড়্গের মতো নেতাকে সামনে রেখে এগোনোর স্ট্র্যাটেজিটি সম্ভবত ভুল। রাহুল যদি নেহাতই নিজের জেদে অনড় থাকেন, তা হলে বিশেষ কিছু করার থাকে না। কিন্তু, দলের অভ্যন্তরে সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ঙ্কাকে টপকে শশী বা খড়্গে যে নিজেদের কর্তৃত্ব ফলাতে পারবেন না, তা এক প্রকার নিশ্চিত। সুতরাং, ব্যক্তিগত মাইলস্টোন ছাড়া না শশীদের কিছু পাওয়ার আছে, না কংগ্রেসের।

বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীর যাবতীয় নির্বাচনী সাফল্য মেনে নিয়েও বলতে হয়, শেষ দু’টি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিকল্প একটি সর্বভারতীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ দলের অভাব বার বার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে, জনসঙ্ঘ তথা বিজেপিকেও প্রায় পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে ভারতীয় রাজনীতিতে যথাযথ জায়গা পাওয়ার জন্য। আম আদমি পার্টি বা তৃণমূল কংগ্রেসের মতো কোনও দলের পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে কংগ্রেসের বিকল্প হওয়া অসম্ভব। আপ-এর নরম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিও একটি বড়সড় প্রশ্ন ঝুলিয়ে রাখে। কংগ্রেসের বিকল্প পাওয়ার চেয়ে বরং বিকল্প কংগ্রেস পাওয়াটা কাজের কাজ হতে পারে। কিন্তু এই নতুন কংগ্রেসকে বুঝতে হবে, কেরল বা ছত্তীসগঢ়ে ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার আপাতসাফল্য দিয়ে বিহারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক মানচিত্রে জায়গা পাওয়া যাবে না; বা, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘নেই’ থেকে ‘আছে’ হওয়ার জন্য কংগ্রেসকে অন্য কারও হাত ধরতেই হবে। এবং এই সমস্ত রাজনৈতিক সমঝোতা নির্বাচনের পর করলে চলবে না, করতে হবে অনেক আগেই। কেন? কারণ, কংগ্রেসের হাতে আদৌ যে কোনও ক্ষমতা আছে, সেটাই মানুষ বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রাক্-নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে মানুষকে বিশ্বাস করানোর প্রথম ধাপ।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগের প্রায় আট মাস ধরে নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে সারা ভারত ছেয়ে ফেলেছিলেন। এবং এ কাজে শুধু বিজেপির কর্মীরা নয়, বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ক্যাডাররাও। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৯ সালেও। অর্থ এবং লোকবলের দিক থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য কংগ্রেসেরও দরকার অতিরিক্ত লোকবল— প্রাক্-নির্বাচনী সমঝোতা সে দিক থেকেও কিছুটা সাহায্য করতে পারে। উত্তরপ্রদেশ-উত্তরাখণ্ড-হিমাচল প্রদেশের মতো উত্তর ভারতীয় রাজ্যে এই মুহূর্তে বিজেপিকে হারানো যে কোনও দলের পক্ষেই দুষ্কর। কিন্তু, এ-হেন উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ব রাজনীতির যোগ্য জবাব হতে পারে দক্ষিণ ভারতের নিজস্ব পরিচিতির রাজনীতি। সেখানে অধিকাংশ হিন্দুর কাছে এখনও নিছক হিন্দুত্বের থেকে নিজস্ব সংস্কৃতির মর্যাদা অনেক বেশি। জগন্মোহন রেড্ডি বা চন্দ্রশেখর রাওদের কাছে টানতে না পারলেও স্ট্যালিন বা পিনারাই বিজয়ন কংগ্রেসকে এই যুদ্ধে বিস্তর সহায়তা করতে পারেন।

কংগ্রেসের আশা এবং কংগ্রেসকে নিয়ে আশা তাই এখনও আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কেন কংগ্রেসকে নিয়ে ভাববেন? ২০২৪-এর নির্বাচনে বিজেপি জিতলে ভারতের ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তার বেশি কিছুও হতে পারে। তুরস্কের এর্দোয়ান এবং হাঙ্গেরির ওরবানের রাজত্বের দিকে তাকালে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এর্দোয়ান ক্ষমতায় আছেন উনিশ বছর ধরে, ওরবান বারো। শেষ পাঁচ বছরে যে সব সাংবাদিক বা বিরোধী রাজনীতিক প্রকাশ্যে এর্দোয়ানের সমালোচনা করেছেন, তাঁদের ধরে ধরে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ওরবানের হাঙ্গেরিতে মুসলিম শরণার্থীদের ঢোকা বন্ধ হয়ে গেছে, সমকামীদের সামান্যতম স্বাধীনতাও নেই, জাতীয়তাবাদী পাঠ্যক্রম না পড়ালেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ, নামে গণতন্ত্র থাকলেও আদতে স্বৈরাচার চলেছে, এবং সে শাসন থেকে মুক্তির কোনও পথ নেই। ভারতের সাধারণ মানুষ মনে রাখতে পারেন যে, স্বৈরতন্ত্রে কিন্তু শুধুমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ঘরেই আগুন লাগে না, সে আগুন প্রকৃত অর্থেই সর্বগ্রাসী। ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী রাজনীতির পাশে না দাঁড়ালে বিপদ অনিবার্য।

ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Congress Rahul Gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE