চশমার ফ্রেমের বিজ্ঞাপনী আকর্ষণ কী কী হতে পারে? চশমাটি পরতে আরামদায়ক, হালকা অথচ টেকসই, দেখতে সুন্দর? অথচ, করোনাকালীন চশমার ফ্রেমের মূল বিজ্ঞাপনী আকর্ষণ হল— ফ্রেমটিকে স্যানিটাইজ় করা। টেকসই, আভিজাত্যপূর্ণ, বিলাসবহুল ইত্যাদি গুণকীর্তনের বদলে অ্যানালগ হাতঘড়ির মূল বিজ্ঞাপনী প্রচার হল— বার বার ঘড়িটি স্যানিটাইজ় করতে পারেন, কোনও সমস্যা হবে না।
করোনাকালে এই ভাবেই বদলে গিয়েছিল অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপনের ভাষা। খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, গত বছর এপ্রিলে প্রথম লকডাউনের সময় থেকে টেলিভিশন চ্যানেলের বিজ্ঞাপনেও পরিবর্তন এসেছে। বন্ধ হয়ে যায় সিমেন্ট, রড, বিলাসবহুল গাড়ি, দামি মোবাইল, বিভিন্ন প্রসাধনী সরঞ্জামের বিপণন। সামনের সারিতে চলে আসে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপন।
মশলার মুখ্য কাজ রান্নায় স্বাদ বাড়ানো। কোভিডের সময় সংস্থা মশলার স্বাদের থেকে গুরুত্ব সরিয়ে, মশলা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কী ভাবে বাড়ায়, তার উপর বিজ্ঞাপনের ভরকেন্দ্র রেখেছে। এমনকি তেলের বিজ্ঞাপনেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কথা। খাবারের স্বাদ অপেক্ষা পুষ্টিগুণ যে বেশি বিবেচ্য— জীবাণু সংক্রমণ-পূর্ববর্তী সময়ে হেলথ ড্রিঙ্ক ছাড়া এই নিয়ে বোধ হয় তেমন আলোচনা অনেক বিজ্ঞাপনেই ছিল না।
কোভিড-১৯’এর সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম— কত জিনিসের সঙ্গেই অকারণে এ কথাটি জুড়ে দেওয়া হল! এক সময় শুরু হল সাবান সংস্থাদের রেষারেষি। কোন সাবান কত দ্রুত কত কার্যকর ভাবে জীবাণু বিনাশ করে— তা নিয়ে চলল প্রতিযোগিতা। স্যানিটাইজ়ারের ক্ষেত্রেও তা-ই। বলা শুরু হল, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’ অনুমোদিত। পরে অবশ্য সংঘাত থেকে সমন্বয়ের পথেই হাঁটল সংস্থাগুলি। ভাষা বদলে গিয়ে হল— কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে এটি বিশেষ কার্যকর, তবে ভাইরাস থেকে বাঁচতে হাতের কাছে এর সমতুল যা পাবেন, তাই ব্যবহার করে সুরক্ষিত থাকুন।
বিজ্ঞাপনের ভাষা বদলে যাওয়া নতুন কথা নয়। শুরুর দিনে জুতো সংস্থার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত— পায়ে কিছু ফুটে গিয়ে ক্ষত হলে তা ধনুষ্টংকারের কারণ হতে পারে। সেই ঝক্কিঝামেলা থেকে রক্ষা পেতে জুতো পরুন। এখন জুতোর প্রচারকৌশলে শুধু পা ঢাকা বা ধনুষ্টংকার থেকে নিরাপত্তাই সব নয়। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে হালকা, আরামদায়ক, প্রতি দিনের অফিস যাওয়া বা সকালবেলা দৌড়ানোর উপযুক্ত— এই বিষয়গুলি।
জুতোর প্রসঙ্গে মনে পড়ল আর একটি প্রচারকৌশল। নতুন জুতোয় ফোসকা পড়তে পারে, তার থেকে হতে পারে পায়ের আলসার। অতএব, সেই উপদ্রব থেকে বাঁচতে ব্যবহার করুন এই জিনিসটি। সেটি কী? অনুমান করতে পারেন? প্রথম দিকে ব্যান্ড-এড’এর বিজ্ঞাপন এই ভাবেই করা হয়েছিল। পরে ব্যান্ড-এড যত বার রূপে গুণে বদলেছে, তত বারই তার বিজ্ঞাপন বদলেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হতাহত প্রচুর। হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স সর্বক্ষণ ব্যস্ত! সেই সময়ের টম্যাটো জুসের বিজ্ঞাপনে লেখা হল— দিবারাত্র পরিশ্রমে ক্লান্ত ডাক্তার এবং নার্সদের চমৎকার এক ‘রিফ্রেশমেন্ট’। স্বাদ-পুষ্টি নয়, বরং কাজে ক্লান্তি এলে এটি হবে রিফ্রেশমেন্ট! দূরপাল্লার ট্রেনে এক দিন এক রাত্রির বেশি যাত্রা করলে জানবেন যে, টম্যাটো জুস বিক্রি করা হয় ‘টাইম পাস’ বলে।
বিস্কুট যখন প্রথম ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ’ হতে শুরু করে, তখন বিজ্ঞাপনে সেটি ছিল উৎসবের দিনগুলিতে আনন্দের উৎস। পরে সেই বিস্কুটের বিপণনী আকর্ষণ স্বাদ ও মচমচে আনন্দের যুগল বাহার। কোভিডের সময় বিস্কুটের বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে ভিতরের অতিরিক্ত প্যাকিং। তা কোভিডের জীবাণু থেকে বিস্কুটকে নিরাপদ রাখে।
আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কমের দিকে। তৃতীয় ঢেউয়ের প্রস্তুতির মাঝে খুলে গিয়েছে শপিং মল। আকর্ষণীয় ছাড়, দারুণ সব অফার নয়। নতুন ভাবে খোলা শপিং মলের বিজ্ঞাপনপত্রগুলিতে উজ্জ্বল উল্লেখ— শপিং মলের সমস্ত কর্মী টিকাপ্রাপ্ত। কিছু বহুজাতিক সংস্থা শোরুমে ঢোকার ক্ষেত্রে টিকার কাগজ অথবা কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার কাগজ দেখানো বাধ্যতামূলক করেছে। সাম্প্রতিক একটি ছবি সমাজমাধ্যমে খুব ঘুরছে, ঝালমুড়িওয়ালা তাঁর কাঁধে ঝোলানো বড় টিনের পাত্রটির সামনে একটি কাগজে ‘ভ্যাকসিন দেওয়া আছে’ কথাটি লিখে সেঁটে রেখেছেন। এও এক অভিনব বিজ্ঞাপনের ভাষা।
আপাতত করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব কমতেই ফিরে আসছে পুরনো বিজ্ঞাপনের ভাষা। মশলার বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে স্বাদ, তেলের বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রে ঝাঁঝ। ফিরছে সিমেন্ট, রড, দামি মোবাইল, ঘড়ি, বিলাসবহুল গাড়ি ও বাইকের গতিময় বিজ্ঞাপন। ফিরছে ফর্সা হওয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপন, ফিরছে পৌরুষের প্রদর্শনও। সঙ্গে ফিরছে পুরুষের প্রসাধনীতে যথারীতি নারীশরীরের বিপুল আবেদনময় উপস্থিতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy