Advertisement
০৬ মে ২০২৪
নতুন করে জাতপাতের প্রশ্ন
BJP

অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ভোট দখল করেই বিজেপি সফল

বাবাসাহেব আম্বেডকর বা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, কেউই জাতপাতের ভেদাভেদ মুছে ফেলতে পারেননি। তা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে এখনও বিদ্যমান।

প্রস্তুত: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা। ৭ অগস্ট, লখনউ।

প্রস্তুত: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা। ৭ অগস্ট, লখনউ। পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:৩৪
Share: Save:

লোকসভা নির্বাচন, ২০১৪। প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা তখনও পুরোপুরি রাজনীতিতে নামেননি। অমেঠীতে দাদা রাহুলের হয়ে প্রচার করতে গিয়ে তিনি অভিযোগ তুললেন যে, নরেন্দ্র মোদী রাজীব গাঁধীকে অপমান করে ‘নীচ রাজনীতি’ করছেন। মোদী যেন ঠিক এরই অপেক্ষায় ছিলেন। বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী ‘নীচ রাজনীতি’-র অভিযোগকে তাঁর ‘নিচু জাতি’-র অপমান হিসেবে নিজের গায়ে মাখলেন। বললেন, “আমি অস্বীকার করছি না যে, আমার জন্ম নিচু জাতিতে। কিন্তু সেটা কি অপরাধ?”

২০১৯। ভোটের আগে মায়াবতী অভিযোগ তুললেন, নরেন্দ্র মোদী নিজেকে মিথ্যেই অনগ্রসর জাতির মানুষ বলে দাবি করেন। তিনি গুজরাতের যে মোধ ঘাঞ্চী বা তেলি সম্প্রদায়ের মানুষ, মোদীই মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাকে ওবিসি তালিকায় ঢুকিয়েছিলেন। সে বারও মোদী সুযোগ হাতছাড়া করেননি। পাল্টা জবাবে বলেছিলেন, “অনগ্রসর শ্রেণি নয়, অতীব অনগ্রসর শ্রেণিতে আমার জন্ম।”

বিজেপি ও আরএসএস নেতৃত্ব বরাবরই দাবি করেন, তাঁরা জাতপাতের রাজনীতির পক্ষপাতী নন। মোদী নিজেও পারতপক্ষে তাঁর ওবিসি পরিচয়ের কথা বলেন না। কিন্তু ২০১৪ বা ২০১৯-এর লোকসভাই হোক বা ২০১৭-র গুজরাত— কাকতালীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভোটের সময়ই মোদীকে তাঁর অনগ্রসর শ্রেণি-পরিচিতির কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। ওবিসি ভোটব্যাঙ্কই তাঁর লক্ষ্য হয়।

সামনে ২০২২-এর উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের অগ্নিপরীক্ষা। বিজেপির পাখির চোখ ফের ওবিসি ভোট। উল্টো দিকে, বিজেপিকে প্যাঁচে ফেলতে গত তিন দশক ধরে জাতপাতের রাজনীতি করে আসা দলগুলি জাতিগণনার দাবি তুলেছে। দুইয়ে মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে মণ্ডল বনাম কমণ্ডলু রাজনীতির দ্বিতীয় অধ্যায় উপস্থিত।

উচ্চবর্ণ, দলিত, ওবিসি, জনজাতি— রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতারা সকলকেই ‘সমগ্র হিন্দুত্ব’-এর ছাতার নীচে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখেন। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত প্রায়ই সংরক্ষণের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে ফেলেন। ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে বিজেপি নেতাদের সেই ক্ষত মেরামত করতে হয়। এ বার উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে ওবিসি ভোট ঝোলায় পুরতে প্রথমে বিজেপি ডাক্তারিতে ওবিসিদের জন্য আসন সংরক্ষণ করেছে। বেছে বেছে ওবিসি নেতাদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছে। রাজ্যের হাতে ওবিসি তালিকা তৈরির ক্ষমতা নিশ্চিত করতে সংবিধান সংশোধন করেছে। কিন্তু উল্টো দিক থেকে দাবি উঠেছে, এতই যদি ওবিসি-দরদ, তা হলে সরকার জাতিগণনার নির্দেশ দিক। ওবিসিদের আসল সংখ্যা নির্ণীত হোক।

মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করে সংরক্ষণ চালু হওয়ার পরে যে সব আঞ্চলিক দলের উত্থান হয়েছিল, সেই লালু-মুলায়ম-মায়াবতী-নীতিশ কুমারদের দলই এখন জাতিগণনার দাবির পুরোভাগে। এমনকি বিজেপির মধ্যে থেকেও ওবিসি নেতারা একই দাবি তুলেছেন। ওবিসিদের জন্য এখন কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষিত। বিজেপির সমস্যা হল, জাতিগণনায় যদি দেখা যায় যে জনসংখ্যায় ওবিসিদের হার এর চেয়ে অনেক বেশি, তা হলে সেই অনুপাতেই সংরক্ষণের দাবি উঠবে। তা মানতে গেলে জেনারেল ক্যাটেগরির জন্য অসংরক্ষিত যে ৫০ শতাংশের বেশি আসন থাকে, সেখানে হাত দিতে হবে। সরকারের উচ্চপদে উচ্চবর্ণের তুলনায় ওবিসিদের বেশি দেখা গেলে সামাজিক সমীকরণই বদলে যাওয়ার আশঙ্কা। তিন দশক আগে মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে যেমন ব্রাহ্মণ, উচ্চবর্ণের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ফের তেমন আন্দোলন শুরু হতে পারে। এখানেই প্রমাদ গনছেন বিজেপি নেতারা। ওবিসি ভোট ধরতে গিয়ে উচ্চবর্ণের ভোট চলে যাবে না তো?

তিন দশক আগে বিজেপি এই মণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলা করেছিল কমণ্ডলু দিয়ে। মোরারজি দেশাইয়ের সময় তৈরি মণ্ডল কমিশন ওবিসিদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিল। মোরারজি নিজে, বা তাঁর পরে ইন্দিরা বা রাজীব গাঁধীদের কেউই প্যান্ডোরার বাক্স খোলার ঝুঁকি নিতে চাননি। ১৯৯০-এর ১৫ অগস্ট বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ আচমকাই লাল কেল্লা থেকে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। বিশ্বনাথ প্রতাপের সরকারে বিজেপির সমর্থন ছিল। অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের আন্দোলন দেখে বিজেপি নেতারা প্রমাদ গনলেন। এ তো হিন্দু ভোটব্যাঙ্কেরই আড়াআড়ি বিভাজন! ফের হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করতে লালকৃষ্ণ আডবাণী রামমন্দিরের দাবিতে রথযাত্রা শুরু করেছিলেন। বিহারে লালু প্রসাদের সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। এর পিছনে বিশ্বনাথ প্রতাপের নির্দেশ রয়েছে, এই অভিযোগ তুলে বিজেপি কেন্দ্রে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ভি পি সিংহের সরকারের পতন হয়।

এই কমণ্ডলু রাজনীতিতে ভর করেই বিজেপি ১৯৯৮ ও ১৯৯৯-এর লোকসভা ভোটে সাফল্যের মুখ দেখে। কিন্তু সে সময় বা তার পরে ২০০৪, ২০০৯, এমনকি ২০১৪-র লোকসভা ভোটেও জাতপাতের রাজনীতি করা আঞ্চলিক দলগুলি যথেষ্ট ভোট পেয়েছিল। খেলা ঘুরতে শুরু করে ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশের ভোট থেকে। ২০১৯-এ বিজেপির বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরার পিছনে আসল কারণ ছিল উত্তরপ্রদেশে এসপি, বিএসপি এবং বিহারে আরজেডি-র ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসানো। উন্নয়ন, জাতীয়তাবাদ বা উগ্রহিন্দুত্ব নয়। মুলায়ম-অখিলেশ-লালু প্রসাদের ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়ে বিজেপি যাদব ছাড়া অন্যান্য ওবিসি ভোট নিজের দিকে টেনেছিল। একই ভাবে মায়াবতীর জাটভ সম্প্রদায় ছাড়া অন্য দলিতদের ভোটও বিজেপি নিজের ঝুলিতে পোরে। ২০১৭-য় বিজেপির উত্তরপ্রদেশ জয়ের পিছনেও বিজেপির এই নিজস্ব ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ কাজ করেছিল। অখিলেশ যাদবের জমানায় যাদবরাই যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা ভোগ করছে বলে অন্য ওবিসি সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ ছিলই। অমিত শাহ সেই ক্ষোভকেই সুচারু ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

বিজেপি পশ্চিমবঙ্গেও ওবিসি তাস খেলার চেষ্টা করেছিল— প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় এলে বাংলায় মাহিষ্য, তেলিদের মতো হিন্দুদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জাতিকে ওবিসি তালিকায় নথিভুক্ত করা হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দশ বছর ক্ষমতায় থেকেও এ বিষয়ে উদাসীন ছিলেন বলে বিজেপি অভিযোগ তুলেছিল। তৃণমূলও তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে একই প্রতিশ্রুতি দেয়। এ বার বিজেপির ওবিসি তাস কাজে না দিলেও, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জাতপাতের রাজনীতির বৃক্ষরোপণ হয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে তার ফল কে পাবে, সেটা অন্য প্রশ্ন।

প্রশ্ন হল, বিজেপি এই নতুন মণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলায় কোন কমণ্ডলু নিয়ে আসবে? উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ফের রামমন্দির ঘিরে আবেগ জিইয়ে তোলা শক্ত। ফলে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় ফের উচ্চবর্ণ, ওবিসি, দলিতকে এককাট্টা করতে বিজেপিকে নতুন পন্থা নিতে হবে।

স্বাধীনতার আগে ১৯৩১-এ শেষ বার জাতিগণনার রিপোর্ট প্রকাশ্যে এসেছিল। ২০১১-য় আর্থ-সামাজিক জাতি গণনা হলেও মনমোহন বা মোদী সরকার তার রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। ওবিসিদের মধ্যে কোন শ্রেণির কতখানি সংরক্ষণ পাওয়া উচিত, তা ঠিক করতে ২০১৭-য় বিচারপতি জি রোহিণী কমিশন তৈরি হয়। চার বছর ধরে কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এ বার জাতিগণনার দাবি উঠেছে। ওবিসিদের আসল সংখ্যা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি বলে সকলের অনুমান। সেই অনুযায়ী সংরক্ষণ দিতে হলে উচ্চবর্ণ বা জেনারেল ক্যাটেগরির আসন কমবে। তার জেরে বিজেপির নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয় রয়েছে।

মণ্ডল কমিশনের আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ ছিলেন উচ্চবর্ণ, মধ্যবিত্ত মানুষের নয়নের মণি। অনগ্রসরদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তিনি উচ্চবর্ণ, মধ্যবিত্ত মানুষের ভোট হারিয়েছিলেন। যে ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এত বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তাদের ভোটও পাননি। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের সামনেও এখন একই প্রশ্নচিহ্ন।

বাবাসাহেব আম্বেডকর বা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, কেউই জাতপাতের ভেদাভেদ মুছে ফেলতে পারেননি। তা রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে এখনও বিদ্যমান। বিজেপির সমর্থন প্রত্যাহারের পরে পদত্যাগের আগে সংসদে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ প্রশ্ন তুলেছিলেন, “কী ধরনের দেশ চান আপনারা?” দেশের সামনে এখনও একই প্রশ্নচিহ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE