করোনার মেঘ এখনও কাটেনি। ঝড়বাদলের রাতে পাখির ডাক শুনলেও যেমন মনে হয় দত্যি-দানোর দাঁত কিড়মিড়, ঠিক তেমনই ভাল খবর এলেও এখন বুকটা কেঁপে ওঠে। আজকের সুখ কালকের অসুখের মাঠ তৈরি করছে না তো? সংক্রমিত ও মৃতের যে হিসেব সরকার দিচ্ছে, তা আমাদের করোনা-ক্লান্ত মনকে এই মুহূর্তে কিছুটা স্বস্তি দিলেও, সামাজিক অবসাদের সঙ্গে ঘর করতে করতে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার সাহসটা যেন আমরা ফিরে পাচ্ছি না। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রথম ঢেউ, দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা দোল খেয়েছি, ডুবেছি, ভেসেছি। উঁকি মেরে এখন যখন আশার আলো দেখার চেষ্টা চলছে, তখনই কানে এল নতুন শঙ্কার ভবিষ্যদ্বাণী— তৃতীয় ঢেউ এল বলে! তা নাকি আবার বাচ্চাদের পক্ষেই বেশি মারাত্মক। করোনা যেন এমন এক দৈত্য, যা প্রথমে মুড়িয়েছে পাকা মাথাগুলো; দ্বিতীয় দফায় তার লক্ষ্য ছিল সমাজের মাঝবয়সিরা; আর এর পরে ধরবে শিশুদের। শুনে আতঙ্কিত আমরা সবাই। প্রশ্ন হচ্ছে যে, এর পিছনে আদৌ বিজ্ঞানের কোনও হিসাবনিকাশ আছে? না কি এই আতঙ্কের পুরোটাই জল্পনা?
নির্বোধ আত্মতুষ্টি, বিজ্ঞানের বদলে বিশ্বাসের উপর ভর করেই দেশের পরিচালকেরা করোনা মোকাবিলায় নিতান্ত কিছু অগোছালো পদক্ষেপ করেছিলেন। ফলে দ্বিতীয় ঢেউয়ে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে দেশকে। বহু স্বজনকে হারিয়ে দেশ আবার গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে পথ হাঁটছে। পরিচ্ছন্ন বিজ্ঞান-ভাবনা ও সরকারি পদক্ষেপের স্বচ্ছতাই এখন পাথেয় হতে পারে। তার বদলে গনতকারের মতো কোন মাসে তৃতীয় ঢেউ উঠবে, কবেই বা তা বেছে বেছে বাচ্চাদের ঘাড় মটকাবে— এগুলো বলে যাঁরা আত্মতুষ্টি পাচ্ছেন, তাঁরা দেশের বিজ্ঞানকে আরও পিছনে ঠেলছেন।
মনগড়া কথা না বলে আমরা বরং কয়েকটা পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করতে পারি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের মধ্যে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডিগুলি নিয়ে একটি দেশব্যাপী গবেষণা চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছে যে, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশু (১০ বছরের বেশি বয়স), উভয় জনসংখ্যারই প্রায় ২৫ শতাংশ সমান ভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছিল। অর্থাৎ, শিশুরাও প্রথম তরঙ্গে বড়দের মতো সমান ভাবে সংক্রমিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের লক্ষণগুলো অপ্রকাশিত ছিল। বিভিন্ন জৈবিক কারণে কোভিড-আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কোনও লক্ষণই থাকে না, বা সামান্য লক্ষণ থাকে। ভারতে দ্বিতীয় তরঙ্গে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছিল। হবে না-ই বা কেন? পরিবারের সকলের যদি কোভিড হয়, তা হলে শিশুরা রক্ষা পাবে, তা কি সম্ভব? যদি শিশু হাসপাতালগুলোতে দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় ভিড় উপচে না পড়ে, তবে কেন এমন আশঙ্কায় ভুগব যে, না-দেখা তৃতীয় তরঙ্গে শিশু হাসপাতালগুলো উপচে পড়বে? বিজ্ঞানের সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব এর বিপরীতেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেশের মানুষকে আগাম বিপদের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। কিন্তু তা যুক্তি ও তথ্যনিষ্ঠ হওয়া দরকার।