রণেন আয়ন দত্ত। —ফাইল চিত্র।
বম্বে, ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট এগজ়িবিশন প্যাভিলয়ন। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি। রণেন আয়ন দত্ত (ছবিতে) সবে তাঁর ছয় ফুট বাই ত্রিশ ফুট মুরাল পেন্টিং শেষ করে একমনে সেটার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে আছি আমি। ডান হাতের মুঠোয় ধরা অ্যালুমিনিয়াম লাঠি, লাঠির মুখে বাঁধা এক তুলি। অন্য হাতে তাঁর রঙের প্যালেট। মুরালের বিষয়, নেহরুর চিন্তা অনুযায়ী ইস্পাত কী ভাবে কৃষি ও শিল্পের বিস্তার ঘটাচ্ছে। পিছনে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিছু গুণমুগ্ধ দর্শক। শিল্পীমহল ও বিজ্ঞাপন জগতে এমনই ছিল রণেন আয়ন দত্তের খ্যাতি যে, উনি যখন কোনও এগজ়িবিশন প্রাঙ্গণে মুরাল ডিজ়াইন করতেন, অন্য ডিজ়াইনাররা নিজেদের কাজ ছেড়ে দেখতে আসতেন।
জানতে চাইলেন, “কী রকম মনে হচ্ছে?” বললাম, নেহরুকে একটু গম্ভীর লাগছে। শুনে উনি বললেন, “একটু আমাকে তুলে ধরুন, প্লিজ়।” তাঁর পাঁচ ফুট উচ্চতার হালকা শরীর তুলতে বিশেষ অসুবিধা হল না। তার পর ম্যাজিক। তিনি অ্যালুমিনিয়াম লাঠির মাথায় বাঁধা তুলি দিয়ে নেহরুর চোখের নীচে একটা ব্রাশের দাগ দিলেন। নিমেষে নেহরুর মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল। হালকা হাসি, আর চোখে যেন একটা ঝিলিক এল। আমি বাকশক্তি হারিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম— যত ক্ষণ না উনি বললেন, “আর কত ক্ষণ আমায় শূন্যে ধরে রাখবেন? এ বার নামান!”
মুরাল সাইজ় যত বড়ই হোক না কেন, গ্রাফের স্কোয়্যার রুলে কাটা স্কেল ড্রয়িং উনি কখনওই করতেন না। থিমটা তাঁর মনের মধ্যে রচনা হয়ে থাকত। দূরে দাঁড়িয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত আন্দাজ করে কম্পোজ় করতেন তিনি। তাই উনি লাঠির মাথাতে তুলি দিয়ে অনায়াসে পেন্টিং করতে পারতেন। কী ভাবে আঁকেন, আমার সেই প্রশ্নের উত্তরে এক দিন বলেছিলেন, “আমি মাথা দিয়ে পেন্টিং শুরু করি। বাকিটা ইনস্টিংক্টে হয়। তবে পুরো ছবিটা আমি নিজের মনে আগেই দেখতে পাই।”
তাঁকে আমি কখনও ধরে ধরে ছবি আঁকতে দেখিনি। তাঁর লাইন ড্রয়িং অথবা তুলির টান ছিল সাবলীল ও গতিশীল— যেন ছুটন্ত ঘোড়া। হয়তো তাই তিনি ঘোড়ার আঁকিবুকি করতে
খুব ভালবাসতেন।
রণেন আয়ন দত্তের প্রতিভা ছিল বহুমুখী। মুরালস, ক্যালেন্ডার আর্ট, এগজ়িবিশন প্যাভিলিয়ন ডিজ়াইন, ইলাস্ট্রেটিভ প্রিন্ট অ্যাড— সবেতেই তাঁর অসাধারণ দখল ছিল। তাঁর থ্রি-ডি ডিজ়াইন এত নিখুঁত ছিল যে ইঞ্জিনিয়াররা তাঁর ড্রয়িং করা প্ল্যানে একটা আঁচড় কাটতে পারতেন না।
আজকাল ইন্টারনেটে অজস্র স্টক ফোটো পাওয়া যায়, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আগে ছিল ব্ল্যাক বুক, যেটা নামীদামি বিজ্ঞাপনের শিল্পীরা ব্যবহার করতেন রেফারেন্সের জন্য। রণেন আয়ন দত্তকে কখনও কোনও রেফারেন্সের উপর নির্ভর করতে দেখিনি। বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকাওয়ালা, বারান্দাতে দাঁড়িয়ে বসা ঘুমন্ত কাকাতুয়া বা রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট— সবই তিনি তড়িৎগতিতে আঁকতে পারতেন। ফিগার ড্রয়িং রণেন আয়ন দত্তের কাছে ছিল জলভাত।
এক দিন অকল্যান্ড প্লেসে নিজের স্টুডিয়োতে রণেন আয়ন দত্ত কাজ করতে করতে, গুনগুন করে গাইছিলেন শচীন দেব বর্মণের ‘আমি সইতে পারি না বলা’। কোনও কাজে আমিও তাঁর স্টুডিয়োতে ছিলাম। মুখের উপরে কমলা রং কেন দিলেন? আমি প্রশ্ন করলাম। মনে হল, আমি ছন্দঃপতন ঘটালাম। গান থেমে গেল। হাতের তুলিটা বদলালেন। তার পর প্যালেটে রং মেশাতে মেশাতে আমাকে বললেন, “আপনার মুখে আমি তিন রকম রং দেখতে পাচ্ছি— হলুদ, সবুজ আর ব্রাউন। সবই আলোছায়ার খেলা। আর্টিস্টের চোখে, সবই ধরা পড়ে। আর্টিস্টরা তাঁদের ক্রিয়েটিভ জাজমেন্ট ব্যবহার করে তা কমায় বা বাড়ায়। আমি তা-ই করেছি, নিজের স্টাইলে। কী মুড দেখাতে চাই, সেটাও ভাবতে হয় রং বাছাই
করার সময়।”
রণেন আয়ন দত্ত ক্যালেন্ডার আর্টেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমি থিম সাজেস্ট করতাম। রিসার্চ করে, ফ্লাই-লিফ আর প্রতি পাতার কপি লিখতাম, গল্প বানিয়ে। বাকিটা ছিল রণেন আয়ন দত্তের অসাধারণ ইলাস্ট্রেশনের জাদু। আমার প্রিয়তম ছিল ইঙ্কওয়েলস অব ইন্ডিয়া। সুভো ঠাকুরের কালেকশন থেকে নেওয়া শ ওয়ালশের জন্য ৬ পাতার ক্যালেন্ডার। ১/৪ ডোভার লেনে উপরের ঘরে মিস্টার দত্তের বাড়ির স্টুডিয়োতে বসে আমি ওঁকে এক-একটা পরিস্থিতির গল্প লিখে পড়ে শোনাতাম। তিনি তখনই ঝড়ের মতো ড্রয়িং করে ফেলে রং দিতে শুরু করতেন। মাঝে মাঝে উনি কোনও পরামর্শ দিতেন আর আমিই নতুন করে গল্পটা
লিখে ফেলতাম।
প্রিন্ট অ্যাডের মধ্যে রণেন আয়ন দত্তের ডিজ়াইন করা শালিমার কোকোনাট হেয়ার অয়েল ছিল খুবই জনপ্রিয়। সেই বিজ্ঞাপনের থিমগুলো সব সময় হত ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি ভিত্তিক। আমি বললাম, পঞ্চতন্ত্রের গল্প নিয়ে কাজ করা যায়। রণেন আয়ন দত্তের তখনই পছন্দ হয়ে গেল। বই কিনে ফেললেন। প্রতি সপ্তাহে একটা করে হাফ পেজ বিজ্ঞাপন বেরোত বাংলা ও ইংরেজি কাগজে। গল্পগুলো আমি ছোট করে লিখে, তাঁকে দিতাম। উনি সেটা পড়ে গল্পটা ইলাস্ট্রেট করতেন চমৎকার ভাবে। প্রতি সপ্তাহে পাঠকরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতেন শালিমার কোকোনাট হেয়ার অয়েলের ‘পঞ্চতন্ত্র টেলস’-এর জন্য।
বিজ্ঞাপন আর শিল্পকে এমন অপরূপ ভাবে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন খুব কম শিল্পীই। তাঁর মৃত্যুতে আক্ষরিক অর্থেই একটি যুগের অবসান হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy