E-Paper

অনন্য এক ক্যামেরাশিল্পী

গৌতম ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪৪
An image of Soumendu Roy

সৌম্যেন্দু রায়। —ফাইল চিত্র।

বিখ্যাত সিনেম্যাটোগ্রাফার রাউল কুটার্ড, যিনি ফরাসি ‘নিউ-ওয়েভ’ ছবির পরিচালক গোদার থেকে ত্রুফো সবার ছবি করেছেন, চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন: “ক্যামেরাম্যানরা হচ্ছে ছবির প্রথম দর্শক। কারণ সে তার ভিউফাইন্ডার দিয়ে শুটিং করার সময় দেখছে যে কী ঘটনা ঘটেছে, সে ছাড়া আর কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না।” তখন ছিল মনিটরহীন যুগ, মনিটর তো হালে এসেছে, আগে আমরা যা শুট করতাম তা ল্যাবরেটরি থেকে প্রিন্ট হয়ে না আসা পর্যন্ত জানতাম না ভুল আছে না ঠিক, অথচ হিসাব করে দেখা গেছে আটানব্বই শতাংশই ঠিক থাকত, বা তারও বেশি। সুব্রত মিত্র বা সৌম্যেন্দু রায় (ছবিতে) যখন সাদা-কালো যুগে কাজ করেছেন, তখন ফিল্মের ‘রাশ’ আসত স্টুডিয়ো-লাগোয়া ল্যাব থেকে; পরে আমাদের সময় এখানে কালার ল্যাব না থাকায় শুটিংয়ের পর জেমিনি বা প্রসাদ ল্যাবে ফিল্ম পাঠিয়ে রাশ আনা হত, তখনও অন্ধের মতো যা তুলেছি প্রায় তা-ই আসত। এই ‘কনফিডেন্স’টা ক্যামেরাম্যানদের ছিল, পরিচালকদের ছিল, এমনকি যাঁরা সহকারী থাকতেন তাঁদেরও। অথচ মনিটরের কোনও ব্যাপারই ছিল না।

এই ফোটো-কেমিক্যাল যুগ বা সেলুলয়েড যুগের অন্যতম মহীরুহ ছিলেন সৌম্যেন্দু রায়, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। এঁরা কাজ শুরু করেছিলেন সাদা-কালো যুগে, তখনকার কত বদল দেখেছেন, আবার কালার আসার পর তার মধ্যেও কত। সৌম্যেন্দুদার যে শিক্ষাটা ছিল, তা একেবারেই স্টুডিয়ো থেকে পাওয়া। ওই সময়ে তো কোনও ফিল্ম স্কুল ছিল না, স্টুডিয়োগুলিই ছিল এক-একটি ফিল্মের স্কুল, ওখানে কাজ করতে করতেই প্রত্যেকে কাজ শিখতেন, সিনিয়ররা শেখাতেন জুনিয়রদের, প্রচুর ম্যাগাজ়িন আসত বিদেশ থেকে। সৌম্যেন্দুদা ক্যামেরার গোড়ার কাজটা শিখেছিলেন স্টুডিয়ো থেকেই। দেওজিভাই পাধিয়ার, জি কে মেহতা এবং রামানন্দ সেনগুপ্তের (যিনি জঁ রেনোয়া-র দ্য রিভার ছবির অপারেটিং ক্যামেরাম্যান ছিলেন, এখানেও বিভিন্ন ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফার হিসাবে প্রসিদ্ধ) কাছে কাজ শিখেছেন তিনি, শুরু করেছিলেন ১৯৫৩ সালে। তখন তিনি ক্যামেরা অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন, সে ভাবেই যুক্ত হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী-র কাজে। কাজ শিখতে শিখতে তিনি স্বাধীন ক্যামেরাম্যান হন।

সিনেমার ‘নিয়ো-রিয়ালিস্টিক অ্যাপ্রোচ’-এ স্নাত হয়ে যে নতুন ধারার সিনেম্যাটোগ্রাফি পথের পাঁচালী-তে প্রবর্তন করলেন সত্যজিৎ রায়; সুব্রত মিত্র আর বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সেই ত্রিবেণী সঙ্গমের কর্মকাণ্ড থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন সৌম্যেন্দু রায়। সিনেম্যাটোগ্রাফার দীনেন গুপ্তের সহযোগী হিসাবে তাঁর করা ঋত্বিক ঘটকের ছবি, বা রাজেন তরফদারের ছবি থেকেও শিখলেন। এক দিকে একের পর এক মানিকদার ছবি থেকে, সুব্রত মিত্রের রিয়ালিস্টিক কাজ থেকে কাজ শিখে এক ধরনের স্টাইল রপ্ত করছেন, অন্য দিকে স্টুডিয়োর ক্যামেরাওয়ার্ক কিংবা আলো করা শিখে আর এক ধরনের স্টাইলও। ফলে দু’ধরনের আঙ্গিক সম্পর্কেই সম্যক জ্ঞান ওঁর রপ্ত হয়েছিল অল্পবয়স থেকেই।

সত্যজিৎ রায় তাঁকে রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্র ও তিন কন্যা ছবির দায়িত্ব দিলেন, সুব্রত মিত্রের তখন চোখের একটু সমস্যা হয়েছিল। একেবারেই স্বাধীন চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব, সৌম্যেন্দু রায় এত ভাল কাজ করলেন যে মানিকদা তারিফ করলেন তো বটেই, তৎকালীন ফিল্মবোদ্ধারাও বললেন, স্বাধীন সিনেম্যাটোগ্রাফার হওয়ার ক্ষমতা সৌম্যেন্দুর রয়েছে। অল্প কাল পরেই অভিযান ছবিরও দায়িত্ব পেলেন। তার পর কাপুরুষ ও মহাপুরুষ, চিড়িয়াখানা হয়ে গুপী গাইন বাঘা বাইন। এখানে সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি নিয়ে তো আলোচনা সম্ভব নয়, কয়েকটি ছবির কিছু স্মরণীয় মুহূর্তের কথা একটু বলতেই হয়। প্রথম কাহিনিচিত্র তিন কন্যা; তিনটি ছোট ছবির সমাহার, তিনটেরই আলাদা আলাদা ফোটোগ্রাফিক টোন। পোস্টমাস্টার-এ বিদ্যুৎহীন গ্রামীণ বাংলার একটি ঘরে লণ্ঠনের আলো যে ‘সোর্স লাইট’ দিয়ে তৈরি করেছিলেন, চিরকাল তা মনে রাখার মতো (প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দিই জন-অরণ্য ছবিতে মোমবাতির আলোয় ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ গানের দৃশ্যের কথা)। মণিহারা ছবিতে সারা ক্ষণ আলোছায়া, টিপিক্যাল ‘হলিউড লাইটিং’; আবার সমাপ্তি-তে সেই অসাধারণ দৃশ্য: মৃন্ময়ী যখন দোলনায় দুলছে চাঁদনি রাতে, পুরোটাই সাদা-কালোয় ‘ডে ফর নাইট’ শুটিং, তখনকার বিশেষ একটি প্রয়োগ। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে রেড ফিল্টার ব্যবহার করে আকাশটাকে অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছিল। তখন স্পেশ্যাল এফেক্ট-এর ব্যবহার ছিল না, পুরোটাই করা হয়েছিল ফিল্টারে। চাঁদনি রাতের সেই দৃশ্য স্মরণীয় হয়ে আছে।

গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে তাঁকে বিরাট কঠিন কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মানিকদা। বংশী চন্দ্রগুপ্তের ওই অভাবনীয় সেটে আলো করার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাতেই অনেকটা স্পেশ্যাল এফেক্ট-এর কাজ করা। তখন কম্পিউটার গ্রাফিক্স ছিল না, দ্বৈত চরিত্রে সন্তোষ দত্তকে এক বার এ দিকে এক বার ও দিকে, দু’বার ভাগ করে ‘রিভার্স’ করে শুট করতে হয়েছিল। আবার মানিকদার সঙ্গে বম্বে গিয়েও স্পেশ্যাল এফেক্ট-এর কাজ করেছিলেন এস ভি রাও-এর (তিনি চমৎকার অপটিক্যাল স্পেশ্যাল এফেক্ট-এর কাজ করতেন) স্টুডিয়োতে— ভূতের নাচের দৃশ্য বা গুপী-বাঘার হাতে তালি দিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। পাশাপাশি ছিল সাদা-কালোয় তোলা শ্যামল বাংলার রূপ, গুপী আর বাঘার প্রথম মোলাকাত, যেখানে বাঘার ঢোলে টপটপ করে জল পড়ছে। অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিতে পালামৌর বিদায়ী গ্রীষ্ম, খাঁ-খাঁ শূন্যতার মধ্যে দূরে সবুজ বনানী; প্রতিদ্বন্দ্বী সীমাবদ্ধ জন-অরণ্য ছবিগুলোয় এই জীবন্ত শহর ও তার আলোআঁধারিকে তুলে এনেছিলেন ক্যামেরায়।

মানিকদার সঙ্গে সৌম্যেন্দুদার প্রথম রঙিন ছবি অশনি সংকেত। তেতাল্লিশের মন্বন্তর নিয়ে এই ছবিতে সবুজ প্রকৃতির মধ্যে যখন গরুর গাড়িতে চাল নিয়ে ফিরছে গঙ্গাচরণ, তার কাছে এসে চাল ভিক্ষা চাইল দীনবন্ধু, বিকেলের স্বাভাবিক পড়ন্ত আলো থেকে দৃশ্যটি পুরোপুরি ‘সিল্যুয়েট’ হয়ে গেল, এমন এক দৃশ্যকল্প যে গা-শিরশির করে ওঠে। শেষ দৃশ্যেও পর্দা জুড়ে এগিয়ে আসা অসংখ্য অভুক্ত মানুষ হাফ-সিল্যুয়েট থেকে সেমি-সিল্যুয়েট হয়ে যায়। এই বৈপরীত্য চিনিয়ে দেয় দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ সঙ্কটকে। মানিকদার পরিকল্পনাকে নিখুঁত ভাবে রূপায়িত করেছিলেন সৌম্যেন্দুদা। সোনার কেল্লা, শতরঞ্জ কে খিলাড়ি, সদ্গতি, ঘরে বাইরে-র অনবদ্য রূপায়ণের কথাও না বললেই নয়।

সিনেমা তৈরিতে ক্যামেরাম্যানের বিরাট দায়িত্ব, কারণ ছবি বানানোর প্রধান হাতিয়ারই হল ক্যামেরা। পরিচালক যা ভাবছেন, যে চিত্রনাট্য লিখছেন, তা তোলাই হচ্ছে ওই ক্যামেরা দিয়ে, তাই অনেকে বলেন— ক্যামেরাম্যানই পরিচালকের চোখ। মানিকদার মতো চিন্তাশীল পরিচালকের ভাবনা ছবির টেক্সচার দিয়ে, আলোর ডিজ়াইন দিয়ে সাজিয়ে দিতেন সৌম্যেন্দু রায়। আরও যে বিশিষ্ট পরিচালকদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন তাঁদের অন্যতম তরুণ মজুমদার, স্বনামে যাঁর প্রথম ছবি আলোর পিপাসা। তাতে একেবারে হলিউড স্টাইলের স্টুডিয়ো লাইটিং— ব্যাকলাইট, ফিলার, সফ্‌ট ওয়াশ লাইট ব্যবহার করেছিলেন ছবির বিষয়ের শর্তানুযায়ী। তরুণবাবুর বালিকা বধূ ছবিতে অসামান্য ক্লোজ়-আপে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে চিনিয়ে দেওয়া, বা কুহেলি-র গা-ছমছমে রহস্যময়তাকে সাদা-কালোয় ফুটিয়ে তোলা ক্যামেরার উপর তাঁর অসামান্য দখলেরই প্রমাণ। বলতে হয় তপন সিংহের এক ডক্টর কি মওত, হুইলচেয়ার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চরাচর ছবির কথা।

সুব্রত মিত্রের বাড়িতে আড্ডায় দেখেছি সেখানে উপস্থিত পূর্ণেন্দু বসু (সত্যজিৎ রায়ের সহকারী চিত্রগ্রাহক) আর সৌম্যেন্দু রায়; সিনেম্যাটোগ্রাফি নিয়ে তাঁদের আলোচনায় যোগ দেওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল। সিনেমার ফোটোগ্রাফির ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা নিয়ে কত আলোচনা যে হত তাঁদের মধ্যে! কত কম খরচে, সীমিত সরঞ্জামে টালিগঞ্জের সিনেম্যাটোগ্রাফিকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করা যায়, সেটাই ছিল ওঁদের সাধনা। কর্মসঙ্গী হিসাবে তাঁরা পেয়েছিলেন উঁচু মানের পরিচালকদের। সৌম্যেন্দু রায় শুধু ক্যামেরাম্যান ছিলেন না, ছিলেন অনন্য এক ক্যামেরাশিল্পী।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Soumendu Roy Cinematographer Bengali Films

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy