Advertisement
০১ মে ২০২৪
Bengali Language

বাংলা ভাষার আপনজন

বাংলা ভাষা নিজের ক্ষমতায় মাথা তুলে দাঁড়াবে, কেরির মনে এই প্রত্যয় ছিল। বাংলা ভাষার পরিশীলিত রূপ, যা গদ্য রচনার জন্য অপরিহার্য, তা নিয়েই শুধু চিন্তিত ছিলেন না তিনি।

William Carey.

উইলিয়াম কেরি। ফাইল চিত্র।

নিখিল সুর
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১০
Share: Save:

আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার ঐতিহ্য প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের অবদানের কথা। আক্ষেপের বিষয়, যে মানুষটি গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ নির্মাণের মতো বাংলা গদ্যের পথ নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন, সেই উইলিয়াম কেরিকে (ছবি) তত মনে পড়ে না আমাদের। এ কথা স্বীকারে কুণ্ঠা থাকা উচিত নয় যে, বাঙালিকে বাংলা গদ্যভাষা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাহেবরা, স্বেচ্ছায়। বাংলা ব্যাকরণের জন্ম ১৭৭৮-এ নাথানিয়েল হ্যালহেড-এর হাতে। তবে তা উপযোগিতা হারিয়েছিল কিছু ত্রুটির জন্য। সেটা তাঁর অক্ষমতা নয়, অসহায়তা। কারণ, তখন বাংলা ভাষার কোনও সুগঠিত রূপ ছিল না। ১৮০৫-এ উইলিয়াম কেরি হ্যালহেড-এর বাংলা বাক্যগঠনের আনুমানিক অন্বয়কে একটা নিয়মে বাঁধেন। বাংলা ভাষার বিশৃঙ্খল রূপের অবসান ঘটে, ফুটে ওঠে একটা নির্দিষ্ট চেহারা।

সে সময় বাঙালি পণ্ডিতরা বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার মনে করতেন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ বাংলায় হতে পারে না, বাংলার সেই কৌলীন্য নেই। হিন্দু পণ্ডিতদের সংস্কৃত নিয়ে অহঙ্কারের অন্ত ছিল না, বাঙালির ভাষা শিক্ষার জন্য একটি বই রচনার তাগিদও তাঁরা বোধ করেননি। অথচ, বিদেশি হয়েও কেরি ছিলেন বাংলা ভাষা নিয়ে দারুণ আশাবাদী, তাঁর বিবেচনায় বাংলা “ওয়ান অব দ্য মোস্ট এক্সপ্রেসিভ অ্যান্ড এলিগ্যান্ট ল্যাঙ্গুয়েজেস অব দি ইস্ট।” বাংলার ব্যবহার খুব সীমিত, এমন ধারণার কোপে পড়েই অবহেলিত হচ্ছে এ ভাষার চর্চা— লিখেছিলেন তিনি।

বাংলা ভাষা নিজের ক্ষমতায় মাথা তুলে দাঁড়াবে, কেরির মনে এই প্রত্যয় ছিল। বাংলা ভাষার পরিশীলিত রূপ, যা গদ্য রচনার জন্য অপরিহার্য, তা নিয়েই শুধু চিন্তিত ছিলেন না তিনি। বাংলা কথ্য ভাষার রূপসন্ধানও ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর সম্পাদিত কথোপকথন-এর সাহিত্যমূল্য নিয়ে পণ্ডিতরা যা-ই বলুন, এ গ্রন্থ সম্পাদনা করে কেরি পথ দেখিয়েছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর ও হুতোমকে। গদ্যের প্রাথমিক প্রয়োজন যোগাযোগ, ‘যুক্তি-চিন্তার বাহন হয়ে মানুষের জ্ঞান-জীবনকে মুক্ত করা’। বাঙালির সেই সামাজিক বাহন গড়তে চেয়েছিলেন কেরি। তাঁর ইতিহাসমালা প্রকাশিত হয় ১৮১২-তে। এর মূল আকর্ষণ সহজ গদ্যশৈলী। কেরির সামনে বাংলা গদ্যের কোনও নমুনা ছিল না। সমস্যাটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন বঙ্গসমাজের নানা স্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়সূত্রে। আসলে বাঙালি পণ্ডিতদের ধারণাই ছিল না যে, তাঁরা যে ভাষায় কথা বলেন ও যা লিখতে চান, এই দুটোর মধ্যে কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে কেরি বাংলা গদ্যগ্রন্থের অভাব টের পেলেন; রামরাম বসুকে দিয়ে লেখালেন প্রতাপাদিত্যচরিত্র, কেরির কথায় বাংলা গদ্যে লেখা প্রথম মৌলিক গ্রন্থ। কেরি নিজে লিখেছিলেন কম, লিখিয়েছিলেন বেশি। তাঁর প্রেরণায় ১৮০১-১৮১৫ সময়কালে রচিত হয় বারোটি বাংলা বই। বাংলার অধ্যাপক হিসেবে কেরির সামনে ছিল তিনটি সমস্যা: বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনা, উন্নত গদ্যশৈলী উদ্ভাবন যা দিয়ে উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক রচনা সম্ভব, এবং মাতৃভাষার প্রতি বাঙালির অনুরাগ সৃষ্টি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য ইউরোপীয় অধ্যাপকের বাংলার প্রতি যে চরম অবজ্ঞা, কেরির কাছে তা ছিল অতি বেদনার।

ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ-এর মতে, কেরি বাংলা ভাষা পছন্দ করতেন তার মাধুর্যের জন্য নয়, বাংলার মানুষের সান্নিধ্যে যাওয়ার সবচেয়ে উপযোগী মাধ্যম বলে। কিন্তু কেরির ভালবাসাকে স্রেফ স্বার্থের নিক্তিতে মাপলে ভুল হবে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষা ও বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে অন্য অধ্যাপক ও কলেজ কাউন্সিলের বিরুদ্ধে একা লড়াই করেছিলেন কেরি। হিন্দুস্থানি ও বাংলা বিভাগকে মিশিয়ে, বাংলা বিভাগের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে যে ভাবে তিনি বাংলা ভাষা ও বিভাগের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিলেন তা এক ইতিহাস। বাংলার গতিময়তাকে সক্রিয় রাখতে ১৮২৪-এ কেরি প্রকাশ করেন ডিকশনারি অব বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, এতে ছিল পঁচাশি হাজার শব্দ। তিরিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। কেরির লড়াই বিফলে যায়নি, ১৮২৮ থেকে তিন বছরে বাংলা বিভাগে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যায় তিন থেকে চৌত্রিশে।

বাংলা ভাষার জন্য কেরি লড়েছিলেন টানা পঁচিশ বছর। গভীর মমত্ববোধ না থাকলে এই ধৈর্য ও ক্ষমতা আসত না। বাঙালি পণ্ডিতদের কাছে ব্রাত্য, অন্য প্রাচ্যভাষার তুলনায় মর্যাদাহীন বাংলা ভাষার অন্তর্লীন শক্তিকে আবিষ্কার করে তাকে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন। নিজের কৃতিত্ব সম্পর্কে উদাসীনতা তাঁর মহত্ত্ব, কিন্তু বাঙালির কাছে তাঁর মহত্ত্ব অন্য জায়গায়: বাংলা যাঁর মাতৃভাষা নয়, এমন এক বিদেশির বাংলা ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালবাসায়। কেরির কাছে বাঙালির কৃতজ্ঞতা প্রসঙ্গে সজনীকান্ত দাস লিখেছিলেন, “অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বৈদেশিক কেরী যাহা বুঝিয়াছিলেন, বাঙালী প্রধানদের তাহা সম্যক প্রণিধান করতে আরও শতাব্দীকাল সময় লাগিয়াছিল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language Bengali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE