Advertisement
০১ মে ২০২৪
Nandalal Bose

নন্দলালের ‘সহজ পাঠ’

বিশ্বভারতীর নান্দনিক বিকাশের অন্যতম রূপকার শিল্পাচার্য নন্দলাল। সর্বাঙ্গীণ শিক্ষায় লেখাপড়ার সঙ্গে কলাচর্চার স্থান এবং মানকে সমান গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ।

—ফাইল চিত্র।

পায়েল বসু
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:১২
Share: Save:

নান্দনিক বিষয়টা জীবনের আর্টের সঙ্গে রুচিসম্মত ভাবে জড়িত। এর খুব একটা সরলীকৃত সংজ্ঞা হয় না। তবে নন্দনতত্ত্বের পাঠ বাঙালির সারস্বত চর্চার সঙ্গে যুক্ত। শিল্পের উপরিতলের রূপটির সঙ্গে এর অন্তর্লীন দর্শনের সত্যিটুকুর কোনও বিরোধ নেই। যেমন, এক জন ছবি আঁকছেন অন্য জন সেই ছবি দেখে নিজেকে সংযুক্ত করছেন! শিল্পীর দেওয়া আর রসিকের নেওয়া, পর্বটির পোশাকি নাম ‘আর্ট’। শিল্প, সৃষ্টি সব সময় আনন্দদায়ক। কেমন ভাবে? সেটা বোঝাবে শিল্পদর্শন। সহজ করেও বলতে গেলে চতুরঙ্গ উপন্যাসের চমৎকার ‘আনন্দ’ ব্যঞ্জনাটিকে মনে পড়তে পারে— “গান যে করে সে আনন্দের দিক হইতে রাগিণীর দিকে যায়, গান যে শোনে সে রাগিণীর দিক হইতে আনন্দের দিকে যায়।”

রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন, নন্দলাল, আমাদের দেশে পলিটিক্সকে যারা নিছক পালোয়ানি বলে জানে, সব রকম ললিতকলাকে তারা পৌরুষের বিরোধী বলে ধরে রেখেছে। ভাবতে অবাক লাগে আজও শিল্পের নানা বিষয় সাহিত্যের আঙিনাতে ব্রাত্য! শিল্পী নন্দলাল বসুর কথাও আমাদের কাছে সেই রকম, এক পাশে অনাদরে পড়ে থাকা। শুধুমাত্র শিবই যে কত রকম এঁকেছিলেন তিনি। ‘সতী’, ‘অন্নপূর্ণা’, ‘আগমনী’, ‘উমার তপস্যা’, ‘উমার শোক’ ছবিগুলি, কিংবা লিনোকাটে করা ‘গান্ধী’র প্রতিচ্ছবি— অসামান্য। অসাধারণ প্রয়োগনৈপুণ্যে শিল্পের এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যাতায়াত করেছেন তিনি। ছবি আঁকা, টেম্পারা, লিথো, উডকাট, ড্রাইপেন্ট বাটিক, ফ্রেস্কো, আলপনা, এমনকি ভারতীয় সংবিধানের মতো রসকষহীন বস্তুকেও যিনি নান্দনিক করে তুলতে পারেন, তাঁর শৈল্পিক স্বকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে না।

যত বড় শিল্পী ছিলেন, ঠিক তত বড়ই শিক্ষক! কখনও নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না। ছাত্ররা পূর্ণ স্বাধীনতায় কাজ করত। তাদের সঙ্গে নিবিড় সম্বন্ধ গড়ে তুলতেন। ছাত্রগোষ্ঠী নয়, এক-একটি ছাত্রকে তিনি শিক্ষার ‘ইউনিট’ হিসাবে দেখতেন। ইন্দিরা গান্ধী যথার্থ বলেছিলেন, শিক্ষক হিসাবে আচার্য নন্দলাল ছিলেন শিল্পের ক্ষেত্রে মুক্তিদাতা। অনেকে বলবেন, নন্দলাল বসু নিজে, সাহিত্যচর্চা নয়, বরং ছবি করাকে নিজের একমাত্র কাজ বলে মনে করতেন! কিন্তু নির্ভার গদ্যশৈলীতে যে ভাবে কঠিন তত্ত্বকথার সহজ ব্যাখ্যা (সা রে গা মা-র মতো কোন রঙের কী ওজন জেনে তুমি কড়ি-কোমল যেমন খুশি বাজাও, ভুল হবে না) তিনি দিয়েছিলেন, সেই সাহিত্যমূল্যকে অস্বীকার করি কেমন ভাবে?

কোথায় তিনি আলাদা ছিলেন? উনিশ শতকের কলকাতায় কোম্পানি আর্ট, ইউরোপীয় স্টাইলের মধ্যেই এ সময় এসে পড়ে কালীঘাটের পট। গ্রামীণ মানুষের সহজাত লোকশিল্প ‘পট’ নিজেকে ভেঙেচুরে শহুরে কায়দা রপ্ত করে নেয়। আর ছিল বটতলার ‘কাঠখোদাই’। শুরু হয় শিল্পের জাতীয় আত্মপরিচয়ের খোঁজ। দেশি মতে ছবি করার জন্য এগিয়ে আসেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শিষ্য নন্দলাল বসু। গভীর দেশাত্মবোধ আর জাপানি চিন্তক ওকাকুরা-র ‘নেচার, ট্র্যাডিশন, অরিজিনালিটি’-র দর্শনকে সঙ্গে করে দেশের নিজস্ব শিল্প আঙ্গিকের অনুসন্ধান ও অনুশীলনে মগ্ন হন নন্দলাল। প্রাচীন ভারতের অজন্তা গুহাচিত্র থেকে সার্থক দেশি ধারার বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন। পরে অজন্তা প্রথাতেই কলাভবনের দেওয়ালে ফ্রেস্কো করেছিলেন। অপূর্ব সহজ-সরল বিষয় (ধান ভানা, মাছ কোটা, মা ও ছেলে, দর্জি, ধুনুরি, কুম্ভকার) নিয়ে আঁকা ‘হরিপুরা পট’ রাজনীতি সচেতন নন্দলালের জাতীয়তাবোধের গভীরতাকে চিনিয়েছিল।

১৯৩৮ সালে গান্ধীজির ডাকে সাড়া দিয়ে হরিপুরায় কংগ্রেসের অধিবেশনে স্থানীয় কঞ্চি, বাঁশ, হাতে বোনা বেতের ঝুড়ি, খড় দিয়ে নির্মাণ করলেন গ্রামীণ আবহ। আবার উজ্জ্বল রং, বলিষ্ঠ রেখার স্বচ্ছন্দ চলন, সাধারণের জন্য সাধারণকে নিয়ে আঁকা ‘হরিপুরা পোস্টার’-কে আম আদমির মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তুললেন। তাই প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে এঁকে নিলেন ভারতবাসীর চলমান জীবনের ছবি। লোকশিল্পের মধ্যেকার সহজ সুর নিয়ে ভারতীয় শিল্পের নয়া ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় মিশে গিয়েছিল গান্ধীজি ও নন্দলালের শিল্পবোধ।

বিশ্বভারতীর নান্দনিক বিকাশের অন্যতম রূপকার শিল্পাচার্য নন্দলাল। সর্বাঙ্গীণ শিক্ষায় লেখাপড়ার সঙ্গে কলাচর্চার স্থান এবং মানকে সমান গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। এই শিক্ষাদর্শকে সুরে ছন্দে রেখায় রঙে আত্মপ্রকাশের ভাষা দিলেন নন্দলাল। আমাদের সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে আছে সহজ পাঠ-এর অলঙ্করণে লিনোকাটের ছবিগুলি।

রবীন্দ্রনাথ নিজে নন্দলালকে অনেকটা ‘গ্রুমিং’ করে নিয়েছিলেন। সাধারণ খদ্দরের বেশভূষা থেকে নিত্য যাপন, জীবন থেকে শিল্প সব কিছুতেই শান্তিনিকেতনের আড়ম্বরশূন্য আভিজাত্যকে বহন করেছিলেন নন্দলাল। পরিচ্ছন্ন রুচির ব্যবহারে উৎসবের শান্তিনিকেতন সেজে উঠত আলপনায়। প্রথম দিকের আলপনা ছিল গ্রামের পার্বণ অনুসারী। নন্দলাল মন্দির-স্থাপত্য-মূর্তির অলঙ্করণ, বা প্রকৃতির মেঘ-জল-ফুল-ফলের মোটিফ ব্যবহার করে মণ্ডন শিল্পের নতুন রীতি শুরু করেন। ‘টেকনিক’ বিষয়ে বলতেন, ফোঁটা হল আলপনার প্রাণ। আলপনা সুন্দর হয় তার গতির সামঞ্জস্যে— নাচের মতো। দু’-এক জন ছাত্র ও শিক্ষককে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মাটির বাড়ি ‘শ্যামলী’ ও কলাভবনের ‘কালোবাড়ি’র দেওয়ালে মাটি, আলকাতরা মিশিয়ে রিলিফ বা মূর্তি-ছবি করেছিলেন— নতুন ধরনের মণ্ডনশিল্প।

আর্ট করে কি পেট ভরে? নিজেকে করা এই প্রশ্নের উত্তরে নিজেই ‘কারুশিল্প’-এর অর্থকরী বা উপার্জনের দিকটিকে সামনে এনেছিলেন। ক্রাফ্ট এবং ক্রাফ্টম্যানশিপ বা শিল্পীর দক্ষ কারিগরিতে গোয়টের মতো তিনি আস্থাশীল ছিলেন। শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণের জন্য শান্তিনিকেতনে মোমবাটিক, চামড়ার উপর নকশা করা শেখানো হত। নন্দলাল ফেলে দেওয়া জিনিস থেকেও নতুন রূপ খুঁজে পেতেন। কলাগাছের কাণ্ড কেটে বা শিরীষ গাছের শুকনো পাতলা ফল দিয়ে নৃত্যনাট্যের জন্য গয়না গড়তেন! “নন্দলাল ক্যান প্রোডিউস সামথিং ফ্রম নাথিং”— মহাত্মা গান্ধীর একটিমাত্র উক্তিই এই জাতশিল্পীকে চেনার জন্য যথেষ্ট।

দেশের মানুষের বোধে ‘সুন্দর’-কে জাগানোর প্রচেষ্টাও দেশেরই কাজ। আর ‘সুন্দর’ নিজস্ব গুণে নান্দনিকতার অতুলনীয় উপাদান। ‘রিল’সর্বস্ব আজকের দুনিয়ায় শান্তিনিকেতনের নন্দনমেলার অনুষঙ্গে সাময়িক নন্দলাল চর্চা চলে আজ।

তবে, যখন এমন ‘মাটিছোঁয়া মানুষ’ ‘আকাশছোঁয়া শিল্পী’ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, তাঁর সামগ্রিক ‘সঙ্গ করা’-ই একটা শিক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nandalal Bose Art artist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE