Advertisement
E-Paper

সর্বজনের চিত্রকর

যে নৈতিক বোধ কাজ করেছিল নন্দলালের মধ্যে, হরিপুরার মঞ্চসজ্জা আর সহজপাঠ-এর চিত্রায়নের মধ্যে তা অক্ষুণ্ণ ছিল।

সুমনা রায়

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২২ ০৫:২৬
জাদুজগৎ: হরিপুরা কংগ্রেসের প্যানেলে নন্দলাল বসুর ছবি, ১৯৩৮

জাদুজগৎ: হরিপুরা কংগ্রেসের প্যানেলে নন্দলাল বসুর ছবি, ১৯৩৮

আমাদের বাড়ির দেওয়ালে ছবি বলতে ছিল কেবল ক্যালেন্ডারের পাতার ছবি, চকচকে পাতায় ছাপা কিছু একটা, ছবির মতো। আর কোনও ছবি কেনার সাধ্য বাবা-মায়ের ছিল না— মানে বলতে চাইছি, কোনও শিল্পকর্ম কেনারই তাঁদের সাধ্য ছিল না, যদি না তা মিলত বিনা পয়সায়, ক্যালেন্ডারের ছবির মতো। তাই নন্দলাল বসুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বেশ দেরিতে। যে বয়সে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতের রুচি গড়ে ওঠে ছেলেমেয়েদের, সে বয়স মনে হয় পেরিয়েই গিয়েছিল।

যা আমি খেয়াল করিনি, তা হল আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল একেবারে জীবনের প্রথম-পড়া বইয়ে— যে বই দিয়ে বেশির ভাগ বাঙালি ছেলেমেয়ে তাদের পড়ার জীবন শুরু করে, সেই সহজপাঠ বইয়ে তাঁর করা ‘লিনোকাট’-এর সঙ্গে। কিন্তু এমনই আমাদের শিক্ষার ধরন যে, ক্লাসে কেবল লেখকের নামই শুনেছিলাম, শিল্পীর নাম কখনও উচ্চারণ করেনি কেউ। আমার মায়ের ক্যালেন্ডার থেকে কেটে রাখা ছবিগুলোই আমার শিল্পকে দেখার চোখ তৈরি করেছিল, সেটাই ছিল আমার কাছে ‘স্বাভাবিক’ দেখা। নন্দলাল ছিলেন আড়ালে, আমাদের শিক্ষকদের বলা কবিতা আর আঁকা ছবি থেকে পাওয়া ঐতিহ্যের অংশ হয়ে। সহজপাঠ-এর পাতায়, ক্যালেন্ডারে, দেশলাই বাক্সে, বিজ্ঞাপনে নন্দলাল বসুর ছবি যেখানে যেমন রূপ নিয়ে জীবন পেয়েছে, সেই সব রূপের মধ্যে দিয়ে আমাদের চেতনায় প্রবেশ করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন আমাদের সংবেদনশীলতায়। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা, কিংবা মিকেলেঞ্জেলোর সিস্টিন চ্যাপেল-এর মতো কোনও একটা বিশেষ শিল্পকর্মকে ‘সেরা কাজ’ বলে চিনে যেমন শিল্পীকে চিনতে শেখে লোকে, তেমন করে আমরা নন্দলালকে চিনিনি।

‘দেখা’ বলতে অবশ্য আমি কেবল চোখের দেখার কথা বলছি না, তার সঙ্গে আসে যে বিবিধ রাজনৈতিক বোধ, তার কথাও বলছি। ভারতের দুই সর্বাধিক আলোচিত রাজনৈতিক চিন্তক ইতিহাসের দুই ভিন্ন মুহূর্তে নন্দলালের দিকে ফিরেছিলেন। এর প্রথম জন ছিল মোহনদাস গান্ধী, যিনি নন্দলালকে হরিপুরা কংগ্রেসের (১৯৩৮) মঞ্চ সাজাতে অনুরোধ করেছিলেন। সুশোভন অধিকারী সম্পাদিত নন্দলালের বাপুজি নামে বইয়ের যে সংস্করণটি আমার কাছে রয়েছে, তার মলাটে নন্দলালের আঁকা একটি রেখাচিত্র রয়েছে, যা জাতির জনকের প্রতিকৃতি।

ওই রেখাগুলির গঠনশৈলী, সেগুলির আপাত-সরলতা, উপবিষ্ট গান্ধীর মূর্তি সামনে নিয়ে আসার ক্ষমতা আমাদের সঙ্গে চিরকাল থেকে গিয়েছিল। আমার ভাই, আমার ক্লাসের বন্ধুরা, আমি, সকলে এ ভাবেই প্রতি বছর গান্ধীকে আঁকতাম গান্ধী জয়ন্তীর দিন, আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে। আমাদের অগোচরে নন্দলাল আমাদের আঁকতে শিখিয়েছেন।

যে নৈতিক বোধ কাজ করেছিল নন্দলালের মধ্যে, হরিপুরার মঞ্চসজ্জা আর সহজপাঠ-এর চিত্রায়নের মধ্যে তা অক্ষুণ্ণ ছিল। এই দুই মুহূর্তের মধ্যে, এবং অবশ্যই তার পরেও, বিশ্বভারতীর কলাভবনের দেওয়ালে তৈরি হবে অসামান্য সব মুরাল। নিজের ছাত্র ও সহকর্মীদের সঙ্গে সেগুলি বানিয়েছিলেন তিনি। সেগুলি আকার-প্রকারে যতই আলাদা হোক, তাদের মূল উদ্দেশ্যটা এক— জীবনের চলনের ছন্দ, আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ত গতিকে ধরা। জীবন কী, কী করে তা চলে, কার মধ্যে দিয়ে তার গতি? হয়তো এই কৌতূহলই রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে কাকের, বা প্রাচীন সম্রাটের সঙ্গে পথের ধারে ঝরা ফুলের মধ্যে বিভেদ করতে দেয়নি তাঁকে।

হরিপুরা কংগ্রেসের প্যাভিলিয়নে আমরা দেখি এক নারীকে যে সুতো টানছে আর কাটছে, যার শরীরের ছন্দ মনে করায় নন্দলালের দেখা মন্দিরের ভাস্কর্যকে, যার কাজ তাকে মিলিয়ে দিয়েছে চরকায়-বসা গান্ধীর সঙ্গে।

এই যে বর্তমানের মুহূর্তকে পৌঁছে দেওয়া প্রাচীন এক শিল্পরীতিতে, এটা নন্দলালের শিল্পকর্মে সর্বত্র দেখা যায়— মুচি যেখানে কাজ করছে, তার পশ্চাৎপট সকলের প্রিয় এক ফেস্কোর মতো। শস্য ঝাড়ছে আদিবাসী মেয়েরা, সেই সব শস্যের আপাত-এলোমেলো রেখা, ফ্রেমের রেখাগুলি ঘনবদ্ধ, যাতে মেয়েদের দেহভঙ্গির দিকে নজর যায়। মীরাবেন গান্ধীর জন্য ছাগল দুইছেন, নৃত্যগীতরত মানুষ, তাদের হাতে বাঁশি, ঢোলক, দফলি। কর্মরত দর্জি, রন্ধনরত মহিলা, সকলেই আসে ‘মিনিয়েচার’ চিত্র-সদৃশ ফ্রেমের মধ্যে। সাবেক চিত্রশিল্পের কাছে ‘স্টিল লাইফ’ বা স্থিরচিত্র যে গুরুত্ব পেয়েছে, নন্দলালের কাছে তা পেয়েছে গতি— মানুষের কাজ, হেঁটে যাওয়া, চলাফেরা-ওঠাবসার ছন্দোময় জীবন ধরা পড়েছে নন্দলালের ছবিতে। হরিপুরার ছবিগুলির মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের হল তিথল সৈকতে গান্ধীর হেঁটে যাওয়ার ছবি।

সহজপাঠ-এর লিনোকাটও এই জন্যই এত প্রিয়। ওই শিশু, ভাতের হাঁড়িতে হাতা ডোবানো ওই মহিলা, পুকুরের ধারের তালগাছ, অপেক্ষারত মাঝি, গরু টেনে ঘরে ফেরা চাষি, আমাদের চোখের বাইরে চলে-যাওয়া গরুর গাড়ি, মাছ, জঙ্গল, ছাতা, কাজ থেকে ফেরার পথে পুরুষ-নারী— রংহীন ছবিতেও যাদের কপালের ঘাম দেখা যাচ্ছে, যেন দেখা যাচ্ছে সন্ধ্যার র‌ং। জগৎকে আমাদের চোখ, আর চেতনায় পৌঁছে দেয়। এমন ছবি এই বিশ্বাস থেকে এসেছে যে প্রতিটি জিনিস, এবং প্রতিটি মানুষ, আমাদের নজর করার মতো বিষয়, এই বিশ্ব এক আশ্চর্য জাদুজগৎ। এর মধ্যে অতীব দর্শনীয়কে বর্জনের ইচ্ছা কাজ করছে, যা আমাদের সাহিত্য-শিল্পের বোধকে কেবল আলোকবৃত্তে আসা কিছু ব্যক্তি বা বিষয়ে আবদ্ধ করতে চায়। নন্দলালের শিল্প যেন মাঝদুপুরে অচেনা লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কোনও আগাম বার্তা ছাড়াই। আমাদের মতো ছেলেমেয়ে, যাদের আর্ট গ্যালারিতে যাওয়ার, শিল্প সম্পর্কে শিক্ষার কোনও সুযোগ ছিল না, তাদের জীবনে এ ভাবেই প্রবেশ করেছিল ‘মডার্নিজ়ম’-এর ধারণা।

অপর যে নেতা নন্দলালকে আহ্বান করেছিলেন, তিনি জওহরলাল নেহরু। নেহরুর ডাকেই নন্দলাল বসু শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিল্পীদের নিয়ে, এবং জবলপুরের বেওহর রামমনোহর সিংহের সঙ্গে মিলে, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার পাতাগুলি চিত্রিত করেন। মহাভারতের নানা দৃশ্য, রথের দৌড়, স্বয়ম্বর, বুদ্ধ, স্বাধীনতার সংগ্রাম আঁকা হয়, আবার থাকে লোকশিল্প আলপনাও। জাতকমালা বা অন্যান্য বৌদ্ধ পুঁথির মতোই অসামান্য চিত্রাঙ্কন হয় সংবিধানের পাতাগুলির চার পাশ জুড়ে।

ঠিক যেমন অজন্তা-ইলোরার গুহায় ভ্রমণ নন্দলালকে বদলে দিয়েছিল, ‘ইউরোপিয়ান আর্ট’-এর চৌহদ্দির বাইরে প্রাচীন শিল্পের দ্বারা পুষ্ট এক সমসাময়িক শিল্পধারা নির্মাণের রসদ জুগিয়েছিল, তেমনই সংবিধান চিত্রিত করার সুযোগকে ব্যবহার করেছিলেন নন্দলাল। তিনি প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত চরিত্রদের মাঝেমাঝেই তুলে এনেছেন বটে, কিন্তু ছবিগুলোর মধ্যে এমনও কিছু আছে যা তাদের সহজপাঠ আর হরিপুরা প্যাভিলিয়নের চিত্রের সঙ্গে যুক্ত করে। তা এই বোধ যে আমরা, যারা ভারতের নাগরিক— ‘উই দ্য পিপল’— এমন ভাবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত হয়ে রয়েছি, যে ভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে, বা কোনও রাজার সঙ্গে, নিজেকে সম্পর্কিত বলে ভাবা আমাদের পক্ষে কঠিন।

নন্দলালের ছবির মানুষগুলো যে ভাবে আমাদের কাছে এসেছে— ছবির গ্যালারির বাইরে জনসমাজে, স্কুলপাঠ্যে, রাজনৈতিক সম্মেলনের মঞ্চে, ভারতের সংবিধানের পাতায়, প্রতিদিনের ব্যবহারের নানা জিনিসে— যাদের অগণিত ‘কপি’ হয়েছে, প্রায়ই মূল শিল্পীর নাম উল্লেখ না করে, সে সবই পথ করে নিয়েছে ওই একটা পঙ্‌ক্তির অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক, এবং প্রবল আবেগপূর্ণ কথাগুলিতে, যা দিয়ে একদা শুরু করা হয়েছিল ভারতের সংবিধানটিকে— ‘আমরা, যারা ভারতের নাগরিক।’

ইংরেজি ও সৃজনশীল রচনা বিভাগ, অশোকা ইউনিভার্সিটি

Nandalal Bose artist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy