Advertisement
১২ নভেম্বর ২০২৪
Child Marriage In West Bengal

বাল্যবিবাহ: সমন্বয়েই প্রতিরোধ

কন্যাশ্রী বা রূপশ্রী প্রকল্পের অর্থ সহায়তা, মেয়েদের ক্ষমতায়ন, শিক্ষা— বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এমন কিছু কার্যকর পদক্ষেপ সত্ত্বেও নাবালিকা বিবাহের হার এখনও চড়া।

An image of Child Marriage

—প্রতীকী চিত্র।

ভুবন ঋভু
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৫
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহের হার উদ্বেগজনক। ভারতে যেখানে বাল্যবিবাহের জাতীয় গড় হার ২৩.৩ শতাংশ, সেখানে বাংলায় সেই পরিসংখ্যান ৪১.৬ শতাংশ! পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) অনুযায়ী বাংলার কোনও কোনও জেলায় এই বিবাহের হার ৫০ শতাংশ ছুঁয়েছে। চতুর্থ সমীক্ষার থেকে রাজ্যে গড় নাবালিকা বিবাহের হারের হেরফের হয়নি। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে রাজ্য সরকারের নানা প্রকল্প সত্ত্বেও এই পরিসংখ্যানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।

কন্যাশ্রী বা রূপশ্রী প্রকল্পের অর্থ সহায়তা, মেয়েদের ক্ষমতায়ন, শিক্ষা— বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এমন কিছু কার্যকর পদক্ষেপ সত্ত্বেও নাবালিকা বিবাহের হার এখনও চড়া। যা দেখিয়ে দিচ্ছে, সমাজের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির দ্বন্দ্বময়তার নিরিখে এই প্রকল্পগুলিকে আরও সুসংহত ভাবে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন রয়েছে।

বহু কারণে বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষার সীমিত সুযোগ, মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে, এই সম্ভাবনা নিয়ে অভিভাবকদের ভীতি, বয়ঃসন্ধির মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য দুশ্চিন্তা, আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা দিক এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যা শুধু বাল্যবিবাহকে বাঁচিয়েই রাখে না, তাকে বাড়তেও সাহায্য করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শিশু পাচার, যা অনেক সময় ঘটে বিয়ের আড়ালে। ভৌগোলিক ভাবেও পশ্চিমবঙ্গ এক স্পর্শকাতর অঞ্চল, যার ফলে সীমান্ত দিয়ে মেয়েদের পাচার প্রতিরোধ করা প্রশাসনের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজ্য সরকার বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখালেও, নীতি ও প্রশাসনের শূন্য স্থানগুলি চিহ্নিত করে দ্রুত পূরণ করে ফেলতে হবে। সে জন্য চাই সুসংহত ব্যবস্থা ও পারস্পরিক সহায়তা। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে উদ্যোগ করা হয়েছে, ফলে বিচ্ছিন্ন সাড়াই মিলছে। সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পরিবেশের স্তরে যদি কোনও সমন্বিত ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতকে ‘বাল্যবিবাহ মুক্ত’ করার দিকে কিছুটা হলেও এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

এই সমন্বয় আনা প্রয়োজন যে সব বিষয়ের মধ্যে, তার মধ্যে রয়েছে নীতি, বিনিয়োগ, সুসংহতি, জ্ঞান, সামাজিক পরিবেশ এবং প্রযুক্তি। এগুলির ইংরেজি শব্দের আদ্যক্ষর জুড়ে হয় ‘পিকেট’ শব্দটি, যা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের একটি কৌশল বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধ, মেয়েদের নিরাপত্তা, ও বিবাহে বাধ্য করার জন্য শাস্তি, এগুলির জন্য চাই নীতি। নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধের পরিকাঠামো তৈরি, বিবাহ না করতে উৎসাহ দেওয়া, বিবাহ প্রতিরোধের জন্য প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য চাই বিনিয়োগ। বিভিন্ন সরকার, সরকারি দফতর এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি, যাঁরা এই উদ্দেশ্যে কাজ করবেন, তাঁদের মধ্যে দরকার সমন্বয়। এই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলির বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা যেন বাল্য বিবাহে উৎসাহ না দেয়, তা দেখতে হবে। এবং সব শেষে, বাল্যবিবাহ রুখতে, নজরদারি করতে ও বিপন্ন মেয়েদের চিহ্নিত করতে প্রযুক্তির প্রয়োজন।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০০৬, ও শিশুদের যৌন নিগ্রহ প্রতিরোধের আইন ‘পকসো’ ২০১২ কঠোর ভাবে প্রয়োগ না হওয়া বাল্যবিবাহে বাড়বাড়ন্তের অন্যতম কারণ। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-র তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১-এ যথাক্রমে ৬৮, ৯৮ ও ১০৫। এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও ভয়াবহ বাস্তবকে ইঙ্গিত করছে। ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে ৯ লক্ষ ২০ হাজার বাল্যবিবাহ হয়েছে, সেখানে নথিভুক্ত মামলার সংখ্যা মাত্র ২৭০। এটা খুবই চিন্তার বিষয়।

এখন সবচেয়ে বড় কাজ হল সুস্পষ্ট ভাষায় কঠোর বার্তা দেওয়া— বাল্যবিবাহ অপরাধ, এবং এর সঙ্গে যিনি বা যাঁরা যুক্ত থাকবেন বা মদত দেবেন তাঁদের শাস্তি পেতেই হবে। এই প্রচারে অভিভাবক, শিশু থেকে শুরু করে গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ অন্য সরকারি সংস্থা, নজরদারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে থাকতে হবে। বিভিন্ন ধর্মের নেতাদেরও শামিল করতে হবে। তাঁদের কাজ হবে মনোভাব পরিবর্তন নিশ্চিত করা। পুরোহিত, কাজি, যাজক-সহ সব ধর্মের প্রতিনিধিদের সজাগ থাকতে হবে। বাল্যবিবাহ দিলে যে তাঁদের মাথাতেও খাঁড়া নেমে আসতে পারে, মনে রাখতে হবে তাও।

রাজ্যে যে সমস্ত কাজ হয়েছে তার সঙ্গে যদি এই ব্যবস্থাগুলিকে যুক্ত করা যায়, তা হলে বাংলা থেকে বাল্যবিবাহ নির্মূল করা সহজ হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এ জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট বাজেট করে একটি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করা।

বাল্যবিবাহ মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে, যা কোনও সামাজিক, ধর্মীয় বা ঐতিহ্য দিয়ে খাটো করে দেখানো যায় না। এই অপরাধ এই মুহূর্তে বন্ধ করা প্রয়োজন। যে শিশুদের বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে ও তারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে, তাদের দায় আমাদের প্রত্যেকের— সামাজিক, নৈতিক, আইনি, আর্থিক ও কৌশলগত দিক থেকে সার্বিক ব্যর্থতা। যত ক্ষণ না আরও সুসংহত ব্যবস্থা করা হচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা কিন্তু ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE