Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
financial crisis

‘আর্থিক রোগ’-এর চিকিৎসা

তবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর অতিমারির প্রভাব বিচার করতে গেলে, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির মধ্যে সর্ম্পক দেখা উচিত।

দেবাশিস মিথিয়া
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:০৬
Share: Save:

গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিই অতিমারির ধাক্কায় বেহাল, তবে ভারতের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। অতিমারির আগে থেকেই ভারতীয় অর্থনীতি ধীরে চলছিল। বেকারত্ব, দারিদ্র, নিম্ন আয়, গ্রামীণ দুর্দশা, অপুষ্টি, আয়-বৈষম্য— সব ব্যাধিই ছিল। তার উপর, ভারতের সাড়ে ছেচল্লিশ কোটি শ্রমিকের ৯১ শতাংশই ছিলেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এই সময়ে তাঁরা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

তবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর অতিমারির প্রভাব বিচার করতে গেলে, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির মধ্যে সর্ম্পক দেখা উচিত। স্বাস্থ্য বলতে শুধু রোগ থেকে মুক্তি নয়, বরং সারা জীবন ধরে নিজেদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা গড়ে তোলার উপায়ই হল স্বাস্থ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়নে, রোগ ও অতিমারির প্রত্যক্ষ প্রভাব হল অসুস্থতার কারণে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া এবং তজ্জনিত আর্থিক চাপ। এ ছাড়াও, অতিমারি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও নানা ভাবে প্রভাবিত করে।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুতে অর্থনৈতিক বিকাশ বা উন্নয়নে স্বাস্থ্যের প্রভাব আলোচিত হয় মূলত মহামারি ও পরজীবীবাহিত রোগের পরিপ্রেক্ষিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যালেরিয়াকে অসুস্থতা ও মৃত্যুর অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই, বিষয়টিকে উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করে, জনস্বাস্থ্য নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ম্যালেরিয়াকে ‘অর্থনৈতিক রোগ’ বলে চিহ্নিত করে। ফলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে অর্থবরাদ্দ প্রভূত পরিমাণে বাড়ে। ‘অর্থনৈতিক রোগ’ কাকে বলে, সেই সংজ্ঞা থেকে বিষয়টির চরিত্র স্পষ্ট হতে পারে। যে কোনও রোগেরই একটি আর্থিক ক্ষতির দিক থাকে। রোগের চিকিৎসাজনিত খরচ তো আছেই, তার পাশাপাশি আছে রোগের কারণে কাজে যোগ না দিতে পারার ফলে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি, আয় হ্রাস। আবার, রোগে কারও মৃত্যু হলে সেটাও পাকাপাকি আর্থিক ক্ষতি। যে রোগের ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে মৃত্যুজনিত আর্থিক ক্ষতির চেয়ে উৎপাদনশীলতাজনিত ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়, তাকে চিহ্নিত করা হয় অর্থনৈতিক রোগ হিসেবে।

সেই একই সময়ে আরও কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণিত হল যে, জনগণের রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, বা রোগ-প্রবণতা কমাতে পারলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। অন্য দিকে, অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল দেখালেন যে, অর্থনীতিবিদরা স্বাস্থ্যকে একটি অর্থনৈতিক চলরাশি হিসেবে তেমন গুরুত্ব দেন না। অর্থাৎ, জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধির সম্পর্ক নিয়ে যে টানাপড়েন, তা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে। ভারতেও সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারির ক্ষেত্রে এই টানাপড়েনের ছবিটা দেখতে পাই। অতিমারি সামলানো যে শুধু মানুষের জীবন রক্ষার জন্যই নয়, অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রেও অতি গুরুত্বপূর্ণ, প্রায় বছর ঘুরে গেলেও এই কথাটা প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

তবে, দারিদ্র দূরীকরণ ও নতুন শতকের উন্নয়ন কর্মসূচি বিষয়ে আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনা গত এক দশক ধরে স্বাস্থ্য, কল্যাণ এবং উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। ২০০১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্তর্গত ‘ম্যাক্রো ইকনমিক্স অ্যান্ড হেলথ কমিশন’ তাদের রিপোর্টে রোগ-ব্যাধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন দেশভিত্তিক অর্থনৈতিক সমীক্ষার ফল থেকে জানা যায় যে, স্বাস্থ্যের উন্নতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৯৬ সালে একটি সমীক্ষায় অর্থনীতিবিদ ব্যারো দেখিয়েছিলেন, মানুষের আয়ু ৫০ বছর থেকে বেড়ে ৭০ বছর হলে, অর্থাৎ ৪০ শতাংশ বাড়লে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বছরে বাড়তি ১.৪ শতাংশ হারে বাড়ে। একই ভাবে, গ্যালপ ও স্যাক্স ২০০০ সালে অন্য একটি সমীক্ষায় বলেছেন, ম্যালেরিয়া ১০ শতাংশ কমাতে পারলে অর্থনৈতিক বিকাশ বছরে ১.৩ শতাংশ হারে বাড়বে। এ ছাড়াও, কয়েকটি মাইক্রোইকনমিক সমীক্ষা উৎপাদনশীলতা ও আয়ের উপর প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখিয়েছে।

জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের মাপকাঠিতে নিয়ে এলে তার একটা মস্ত সুফল হল এই যে, এমনিতে সমস্যাটা যাঁদের নজর এড়িয়ে যায়, অর্থনীতির প্রশ্নে তাঁরাও বিচলিত হন। কোভিড-১৯’এর মতো রোগ দেখিয়ে দেয়, অসুস্থতা আর মৃত্যুর চেয়েও আর্থিক সঙ্কট অনেক বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে অনেক বড় মাপের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। রোগ নিয়ন্ত্রণ তো বটেই, তার পাশাপাশি আর্থিক সুরাহা করা, খাদ্যের নিরাপত্তা দেওয়াও ‘অর্থনৈতিক রোগ’-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অপরিহার্য পন্থা। ভারতে কোভিড সংক্রমণের হার এখন নিম্নমুখী। কিন্তু, আর্থিক ব্যাধির অন্য লক্ষণগুলি কমার নাম নেই। এই বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বহু টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে জানালেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু, ভবিষ্যতে আবার কোনও ‘অর্থনৈতিক রোগ’-এর হাতে গরিব মানুষের বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কাঠামোগত ভাবনার সন্ধান এই বাজেটে পাওয়া গেল কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

financial crisis Pandemic Coronavirus Pandemic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE