Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Indian Democracy

গণতন্ত্রের যাত্রাভঙ্গ

সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪তম সংশোধন করার পিছনে একটি স্বপ্ন ছিল। তা হল, কেন্দ্র-রাজ্য পার করে স্থানীয় স্তরে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তার নাম পঞ্চায়েতি রাজ।

পঞ্চায়েত নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয় তার জন্য রাজ্য স্তরে নির্বাচন কমিশন তৈরি হল। মহিলাদের জন্য ৩৩ ভাগ আসন সংরক্ষিত হল।

পঞ্চায়েত নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয় তার জন্য রাজ্য স্তরে নির্বাচন কমিশন তৈরি হল। মহিলাদের জন্য ৩৩ ভাগ আসন সংরক্ষিত হল। ফাইল ছবি।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৪৯
Share: Save:

তিরিশ বছর কম সময় নয়। ১৯৯১-৯২ সালে দুটো বড় মাপের সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল— অর্থনৈতিক উদারীকরণ, আর গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ। প্রথমটি এখনও বহু চর্চিত, দ্বিতীয়টি প্রায় বিস্মৃত। কেন এমন হল, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এক বার ফিরে দেখা দরকার।

সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪তম সংশোধন করার পিছনে একটি স্বপ্ন ছিল। তা হল, কেন্দ্র-রাজ্য পার করে স্থানীয় স্তরে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তার নাম পঞ্চায়েতি রাজ। স্থানীয় সরকার যাতে পর্যাপ্ত শক্তি পায়, তার জন্য তাকে দেশের ও রাজ্যের অর্থ ভান্ডারের অংশীদার করা হল। স্থানীয় সরকার যাতে কর নিতে পারে, তার ব্যবস্থাও হল। পঞ্চায়েত নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয় তার জন্য রাজ্য স্তরে নির্বাচন কমিশন তৈরি হল। মহিলাদের জন্য ৩৩ ভাগ আসন সংরক্ষিত হল। স্থানীয় সরকারের কাজকর্ম যাতে মানুষের সমস্যা ও চাহিদাকে ঘিরে তৈরি হতে পারে, তার জন্য ‘গ্রামসভা’ সাংবিধানিক মর্যাদা পেল। তার পর আরও অনেক কিছু রাজ্যগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া হল— স্থানীয় সরকারগুলি কী কী অধিকার ও দায়িত্ব পাবে, কর্মী কোথা থেকে আসবে, সরকারি দফতরগুলির সঙ্গে স্থানীয় সরকারের সম্পর্ক কী হবে, রাজ্য সরকারের কোন কোন অংশ স্থানীয় সরকারের আওতায় আসবে, গ্রামসভার কাজ কী কী হবে, ইত্যাদি।

স্থানীয় সরকার কতটা শক্তিশালী হতে পারে, এবং তা হলে শাসনব্যবস্থায় ও মানুষের জীবনে কী পরিবর্তন হতে পারে, ৩০ বছর বাদে তা দেখতে গেলে একটাই গন্তব্য আছে, কেরল। পশ্চিমবঙ্গ ও কর্নাটক অনেক আগেই রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের কাজ শুরু করেছিল, কিন্তু কেন্দ্রীভূত রাজনীতির জাঁতাকলে অচিরেই বিপথগামী হল। বাকি দেশটা বিকেন্দ্রীকরণের পথেই গেল না। দলতন্ত্র আর আমলাতন্ত্র এক হয়ে কী ভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হতে দিল না, আর সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থাটিকে কী ভাবে দেখল, তার কাহিনি চমকপ্রদ।

প্রথমত নির্বাচন। একাধিক রাজ্যে নির্বাচন পিছনোর চেষ্টা হয়েছিল, যার মধ্যে বিহার ও ঝাড়খণ্ড অন্যতম; তবে ২০০০ সাল নাগাদ বেশির ভাগ রাজ্যই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। ক্রমশ মহিলা ও দলিত জনজাতি সংরক্ষণও প্রতিষ্ঠা হয়। আজ প্রায় ৮৬ ভাগ ক্ষেত্রে নিয়মিত স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হচ্ছে, এবং স্থানীয় সরকারগুলি পাঁচ বছর কাজ করতে পেরেছে। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধিদের সংখ্যায় ভারতের একটা বিশ্ব রেকর্ড আছে; সারা দুনিয়ার নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধিদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়ে বেশি। যদিও, কোন মহিলারা নির্বাচনের টিকিট পান, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গিয়েছে।

কিন্তু রাজ্যের অর্থভান্ডার থেকে টাকা বরাদ্দ? এই বাঁটোয়ারার জন্য রাজ্য অর্থ কমিশন গঠন হওয়ার কথা। বহু দিন পর্যন্ত কমিশন গঠনই হল না বহু রাজ্যে (এখনও ঝাড়খণ্ডে নেই)। কমিশন রাজস্বের যতটা অংশ স্থানীয় সরকারকে দিতে বলল, তা দিল না রাজ্য সরকার। অনেক কম, অনেক দেরিতে টাকা এল পঞ্চায়েতে। স্থানীয় সরকারের দফতর চালানোর জন্য কর্মীও দিল না রাজ্যগুলি। কেরলে একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে কর্মী সংখ্যা ২৫-২৭, সেখানে উত্তরাখণ্ডে আটটি গ্রাম পঞ্চায়েতের জন্য বরাদ্দ এক জন কর্মী। সবচেয়ে বড় কথা, স্থানীয় সরকার হিসাবে কাজ করতে গেলে পঞ্চায়েতগুলির যে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা দরকার, সেটাই দেওয়া হল না। তাদের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্থানীয় এজেন্সি’ করে রাখা হল। যেন গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি নির্বাচিত সরকার নয়, রাজ্য প্রশাসনের কোনও একটা দফতরের ব্রাঞ্চ অফিস। পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে ক্ষমতা কিছুটা হস্তান্তর হয়েছিল গ্রামের স্তরে, তবে তার রাশ গেল প্রধানত পার্টির লোকাল কমিটির হাতে। কেরলের মতো স্থানীয় সরকারের নিজস্ব শক্তি তৈরি হল না।

একুশ শতকে এসে পঞ্চায়েতব্যবস্থাকে এড়ানোর ঝোঁক দেখা গেল। চন্দ্রবাবু নায়ডু স্থানীয় সরকারকে পাশ কাটিয়ে স্বনির্ভর দলগুলির ফেডারেশন তৈরি করলেন, এবং প্রশাসনের সঙ্গে ফেডারেশনগুলির সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করলেন। অন্ধ্রে জগন রেড্ডি পঞ্চায়েতকে দূরে রেখে তৈরি করলেন ‘গ্রাম সেক্রেটারিয়ট’, তাঁর পার্টির স্থানীয় কর্মীরা চাকরি পেলেন। মমতাও একই পথে হাঁটলেন, স্থানীয় সরকারকে এড়িয়ে সরকারি কর্মীদের ব্যবহার করে নিয়ে এলেন ‘দুয়ারে সরকার’। সংবিধানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় সরকারই যে আসলে ‘দুয়ারে সরকার,’ কেউ সে আপত্তি তোলেনি। এখন ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেন সেই পথে হাঁটছেন। কেন্দ্রীয় সরকারই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? একশো দিনের কাজ ও আবাস যোজনা, যে দু’টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের রূপায়ণে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা ছিল মুখ্য, সেগুলি থেকে পঞ্চায়েতকে ক্রমশ সরিয়ে দিল, দু’টি প্রকল্পেই এখন আমলাদের প্রাধান্য। সব মিলিয়ে দাঁড়াল, কেরলকে বাদ দিলে কোথাও স্থানীয় সরকার মর্যাদা পেল না। সংবিধানের প্রতিশ্রুতি মাটি চাপা পড়ল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE