Advertisement
০৫ মে ২০২৪
মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারত একেবারে পিছনের সারিতে
Indian Economy

‘ধনী’ দেশ, গরিব মানুষ

মোদী জমানাতেই যে ভারত বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে, সে কথা ঠিক। ব্রাজ়িল, ইটালি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো দেশকে ভারত পিছনে ফেলে এসেছে।

খোয়াবনামা: লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৫ অগস্ট ২০২৩।

খোয়াবনামা: লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৫ অগস্ট ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২৩ ০৪:২২
Share: Save:

নরেনবাবুর ভরা সংসার। তিনি, তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে। তার উপরে বড় ছেলেটি চাকরি পেয়ে বিয়ে করেছে। নরেনবাবু নিজে এখনও চাকরি করছেন। বাপ-ছেলে মিলিয়ে মাসে দেড় লক্ষ টাকা রোজগার করেন। তবু মাসের শেষে সংসার খরচে টান পড়ে। পাশের বাড়ির বিজয়বাবুর স্বামী-স্ত্রী দু’জনের ছোট পরিবার। দু’জনেই চাকরি করেন। মাস গেলে এক লক্ষ টাকা আয় হয়। তবে হেসেখেলে সংসার চলে যায়।

নরেনবাবুর পারিবারিক আয় মাসে দেড় লক্ষ টাকা হলেও বুঝেশুনে সংসার চালাতে হয়, কারণ তাঁর পরিবারে লোকসংখ্যা ছয়। ফলে মাথাপিছু আয় মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা। বিজয়বাবুর পারিবারিক আয় এক লক্ষ টাকা— মোট টাকার অঙ্কে নরেনবাবুর পারিবারিক আয় বিজয়বাবুর দেড় গুণ— কিন্তু পরিবারে তাঁরা মাত্র দু’জন বলে মাথাপিছু আয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। তাই তাঁরা স্বচ্ছন্দে থাকেন।

এই অবস্থায় নরেনবাবু মোট পারিবারিক আয়ের হিসাব দিয়ে নিজেদের বিজয়বাবুর পরিবারের তুলনায় বেশি অবস্থাপন্ন বলে দাবি করবেন কি না, সেটা তাঁর কাণ্ডজ্ঞানের প্রশ্ন— তবে, তেমন দাবি করলে লোকে নির্ঘাত হাসবে। মোট আয়ে কিছুই আসে-যায় না। বাস্তবে নরেনবাবুর পরিবারের মাথাপিছু আয় অনেক কম। বিজয়বাবুদের মাথাপিছু আয় তার দ্বিগুণ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন দাবি করছেন যে, তিনি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে জিতে আসবেন এবং তাঁর তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। এই দাবি নরেনবাবুর বেশি অবস্থাপন্ন হওয়ার দাবির মতোই। ভারত এখন জনসংখ্যার বিচারে গোটা বিশ্বে এক নম্বরে। ১৪০ কোটি মানুষের উন্নয়নশীল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-ও যে বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই জিডিপি-র নিরিখে ভারতই এখন ব্রিটেনকে টপকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েছে। সামনে এখন চারটি দেশ— আমেরিকা, চিন, জার্মানি ও জাপান। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেই ভারত জার্মানি ও জাপানকে পিছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাবে।

তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারত জার্মানি ও জাপানের চেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হয়ে উঠবে? একেবারেই নয়। ভারতের অবস্থা নরেনবাবুর সংসারের মতো— আয় বেশি, কিন্তু লোকসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় মাথাপিছু আয় খুবই কম। জার্মানি, জাপান বা ব্রিটেনের মাথাপিছু আয় ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যেমন ব্রিটেন, যাকে পিছনে ফেলে ভারত পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি এখন ২২০০ ডলারের সামান্য বেশি। আর ব্রিটেনের মাথাপিছু জিডিপি ৪৭,৩৭৪ ডলার। মোদী সরকার তার ধারেকাছে যাওয়ার কথা ভাবছেই না, চেষ্টা করা তো পরের কথা। জিডিপি-র নিরিখে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পারে, কিন্তু মাথাপিছু আয়ে ভারত ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৪১তম স্থানে। একেবারে পিছনের সারিতে।

তা হলে নরেন্দ্র মোদী পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার স্বপ্ন ফেরি করছেন কেন? উত্তর একটাই। আগামী বছরের লোকসভা ভোট। গত জুন মাসে আমেরিকার কংগ্রেসে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রথম গর্ব করে বলেছিলেন, ২০১৪-য় তিনি যখন ক্ষমতায় এলেন, তখন ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতি। তাঁর দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। তৃতীয় দফায় তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাবে। এর পরে প্রধানমন্ত্রী গত তিন সপ্তাহে তিন বার একই কথা বলেছেন। প্রথমে জি২০ শীর্ষ বৈঠকের জন্য তৈরি সম্মেলন কেন্দ্রের উদ্বোধনে। তার পরে লোকসভায়। শেষে স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লা থেকে। এমন কথা শুনে দেশের আমজনতার বুক গর্বে ফুলে ওঠাই স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদীর ভক্তরা তাঁকেই এই সাফল্যের কৃতিত্ব দেবেন। আর বিজেপি তার সুফল ভোটে কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তৃতীয় দফায় তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়ে লোকসভা ভোটের বৈতরণি পার হয়ে যেতে পারে।

মোদী জমানাতেই যে ভারত বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে, সে কথা ঠিক। ব্রাজ়িল, ইটালি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো দেশকে ভারত পিছনে ফেলে এসেছে। কিন্তু এই সব দেশের তুলনায় কি ভারত অনেক উন্নত হয়ে উঠেছে? না। কারণ, ভারতের মাথাপিছু আয় এ সব দেশের তুলনায় এখনও অনেক কম। মাথাপিছু আয়ের নিরিখেও অবশ্য মোদী জমানায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০১৩-১৪’য় ভারত ছিল ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৪৭তম স্থানে। সেখান থেকে ভারত ১৪১তম স্থানে উঠে এসেছে। নিকারাগুয়া, উজ়বেকিস্তান, নাইজিরিয়া, ঘানা, কেনিয়া, লাও পিডিআর-এর মতো দেশকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এই মোদী জমানাতেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে।

আর একটি বিষয়ও খেয়াল রাখা দরকার। তা হল, এই যে আগামী পাঁচ বছরে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠার কথা বলা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার কিন্তু সেই লক্ষ্য স্থির করেনি। প্রধানমন্ত্রী শুধু ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, এমনটা হবে। কী ভাবে? বাস্তবে, প্রধানমন্ত্রীর আগেই অর্থনীতির আন্তর্জাতিক মূল্যায়নকারী সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর এবং মর্গান স্ট্যানলি এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারও একই কথা বলেছে। কারও মতে ২০২৯-এ ভারত তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে। কারণ, ২০২৭-এই সেটা সম্ভব। ব্যাপারটা খুব সহজ। ভারতের জিডিপি এখন ৩.৭ লক্ষ কোটি ডলার। জাপানের ৪.৩ লক্ষ কোটি ডলার, জার্মানির ৪.৩ লক্ষ কোটি ডলার। দু’টিই যথেষ্ট উন্নত, সমৃদ্ধ অর্থব্যবস্থা। ফলে তাদের আর্থিক বৃদ্ধির হারও অনেক কম। ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি এখনও আশানুরূপ নয়। আট বা নয় শতাংশের বদলে এখন ছয় থেকে সাত শতাংশ বৃদ্ধি হলেই মোদী সরকার খুশি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির হিসাবে, পাটিগণিতের নিয়মে এই বৃদ্ধির হার নিয়েই ভারত খুব শীঘ্রই জার্মানি ও জাপানকে পিছনে ফেলে দেবে।

আলিপুর আবহাওয়া দফতর নিম্নচাপের ফলে বৃষ্টির পূর্বাভাস দিলে অনেকেই পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে গম্ভীর গলায় ‘কাল বৃষ্টি হবে’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এ-ও তেমনই। আসলে ভারতের অর্থনীতি নিজের গতিতেই তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে কুটোটিও নাড়তে হবে না। শুধু সাধ করে নোট বাতিলের মতো বিপদ ডেকে আনা চলবে না। আর কোভিডের মতো দুর্যোগ যাতে এসে না পড়ে, তার প্রার্থনা করতে হবে।

তৃতীয় স্থানে পৌঁছে বিজেপি বলবে, মোদীজি যেমন বলেছিলেন, তেমনটাই করে দেখিয়েছেন। এতে কোনও ভুল নেই যে, মোদী জমানায় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ২০১৪-১৫’য় মাথাপিছু আয় ছিল বছরে প্রায় ৮৬ হাজার টাকা। ২০২২-২৩’এ তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, বছরে প্রায় ১ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। অর্থাৎ, মাসে ১৪,০০০ টাকার মতো। তবে তাতেও পুরো ছবিটা বোঝা যায় না। কারণ সকলের আয় সমান ভাবে বাড়েনি। উল্টে আর্থিক অসাম্য বেড়েছে। বিশেষত কোভিডের পরে। আয়ের মাপকাঠিতে উপরের সারিতে থাকা জনসংখ্যার ১ শতাংশ ধনকুবেররা এখন দেশের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদের মালিক। গড়পড়তা আমজনতার আয় কমেছে। তার উদাহরণ হল, গত চার বছরে আয়করদাতার সংখ্যা ৬০ শতাংশ কমেছে। ২০১৯-২০’তে প্রায় ৩.৫৭ কোটি মানুষ আয়কর মিটিয়েছিলেন। ২০২২-২৩’এ তা ২.২৩ কোটিতে নেমে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী ২০৪৭-এ উন্নত ভারতের স্বপ্ন ফেরি করছেন। শুধু অর্থনীতির বহর বাড়লে তা সম্ভব নয়। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লে, আয়বৃদ্ধির বৈষম্য কমলে দেশ সমৃদ্ধ হবে। না হলে নরেনবাবুর মতোই টেনেটুনে সংসার চালাতে হবে। যথা পূর্বম্।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Economy Narendra Modi BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE