Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
pirzada Abbas siddiqi

ধর্মলাঞ্ছিত ভোটের উৎসব

আব্বাসের ফ্রন্টটিতে কোনও ইসলামি দল বা অন্য কোনও ধর্মীয় সংস্থা নেই।

মৃদুল দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২১ ০৫:৩৫
Share: Save:

বিরক্তিকর এক আত্মজিজ্ঞাসার উদয় হয়েছে মনে— নিজেকে কি এক জন ‘হিন্দু ভোটার’ ভাবছি আমি? কস্মিন্কালেও কোনও নির্বাচনের আগে কখনও ভাবিনি, ভাবতে হয়নি, আমি ‘হিন্দু ভোটার’।


এ রাজ্যে বিজেপি যখন থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে, তখন থেকেই এই দলটির বিরুদ্ধে মেরুকরণের রাজনীতির অভিযোগ। বিজেপি তার বিরুদ্ধে ওঠা সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নিজস্ব ব্যাখ্যা দিলেও, মেরুকরণের বিষয়টিতে নির্বিকার। কারণ, মেরুকরণের রাজনীতিতেই বিজেপির সিদ্ধি এবং সাফল্য।


ওই উঁকিঝুঁকি দেওয়ার সময়টিতে, মন্দির আন্দোলনের সূচনার সময়টিতে এ রাজ্যে বাড়ির পাঁচিলে, সদর দরজায় লাল হলুদে ছাপানো স্টিকার সেঁটে দেওয়া হত, তাতে হিন্দিতে লেখা: ‘গর্‌ব সে বোলো, হম হিন্দু হ্যায়’। গৈরিকীকরণের ওই পয়লা পদক্ষেপ। এ বারের বিধানসভা ভোট একেবারে সম্প্রদায়, জাতপাতের ভোট হয়ে পড়েছে, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে কখনও ঘটেনি। বিশেষত বামফ্রন্ট-কংগ্রেস তাদের জোটে ফুরফুরার তরুণ পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সদ্য গড়া দল আইএসএফ-কে শরিক করায় এ বারে ভোট নিয়ে যে কোনও আলোচনা, কথাবার্তায় ধর্ম ও রাজনীতি একেবারে গলা-জড়াজড়ি করে ফেলেছে।
কংগ্রেস বা সিপিআইএম দলের অন্দরে এ নিয়ে কথা উঠেছে। তবে ব্রিগেড সমাবেশে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির উপস্থিতিতেই বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, সূর্যকান্ত মিশ্র, অধীর চৌধুরীরা আব্বাসের হাত ধরেছিলেন। ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে সিপিএম-কংগ্রেস হাত মেলানোয় মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে, তা মনে করছি না। ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন মাত্রেই বিষবৎ পরিত্যাজ্য, এ বড় মূর্খামি। আব্বাস নমাজি টুপি পরেন, তাঁর থুতনিতে কয়েক গাছি দাড়িও আছে, তাই আব্বাস ঘোরতর সাম্প্রদায়িক— এ সব ভাবনাই হিন্দুত্ববাদী। হরকিষেন সিংহ সুরজিৎ মাথায় পাগড়ি পরতেন, তাঁর সুচর্চিত দাড়ি ছিল। হাতে বালা। কোনও উসখুস তো শোনা যায়নি। গৈরিক বসনধারী হিন্দু সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী, মেনে নিতে কারও অসুবিধা হয়নি! অথচ, যোগীর দলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেতারা অভিযোগ তুলছেন, বাম-কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
বছর দুই আগের ধুলাগড়ে, তার পর ভাঙড়ে উত্তেজনা প্রশমনে আব্বাস সিদ্দিকির ভূমিকা স্থানীয় সিপিএম জেলা নেতৃত্বের নজরে পড়ে। বাম-কংগ্রেসের ব্রিগেড সমাবেশে আব্বাস তাঁর ফ্রন্টটিকে সংযুক্ত মোর্চায় শামিল করে নিয়েছেন।


ব্রিগেড সমাবেশ ও তার আগে পরে আব্বাস সিদ্দিকির ধর্মীয় সমাবেশ জলসার কয়েকটি ভিডিয়ো ভাষণ শুনেছি। তাতে আব্বাস যে তর্জনগর্জন করেছেন, তা অপরিণত, এবং ইসলামি ব্রাদারহুডের অনুকরণ বা অনুরণন। তরুণ আব্বাস ওই দিকে চলে যেতে পারতেন, বামপন্থীরা কি তাঁকে সামাল দিচ্ছেন? একেবারে হাল আমলে আব্বাস বলছেন— “গরিবগুলোর কী হবে? শুধু মুসলমানের কথা বলছি না, ঠিক কি না, বলছি গরিব ব্রাহ্মণগুলোর কথাও, ঠিক কি না, এই প্রশ্ন তোলা ঠিক না বেঠিক?” আব্বাসের এ ভাষা হুগলির মাটির মানুষের ভাষা।


আব্বাসের ফ্রন্টটিতে কোনও ইসলামি দল বা অন্য কোনও ধর্মীয় সংস্থা নেই। রয়েছে: রাষ্ট্রীয় দলিত একতা মঞ্চ, অখিল ভারতীয় বিকাশ পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ বাউরি জাতি বিকাশ সঙ্ঘ, ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল, আদিবাসী কুড়মি সমাজ, জঙ্গলমহল মূলনিবাসী একতা মঞ্চ, ভারতীয় আদিবাসী ভূমিজ সমাজ, আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ এবং এসটিএসসি ওবিসি অধিকার রক্ষা মঞ্চ— এই নয়টি সংগঠন। এই ফ্রন্টের সভাপতি: শিমুল সোরেন। সম্পাদক: আব্বাস সিদ্দিকি।
মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির উপর আঘাতকারী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃশ্যত দু’টি শিবিরই যুযুধান। একটি রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, আর একটি কেন্দ্রের সরকারে আসীন বিজেপি। রণাঙ্গনের একটি কোণে বৃক্ষতলে আর একটি জমায়েতেও ভিড় জমছে, তাও দৃশ্যমান। ও-ই সংযুক্ত মোর্চা। সেটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে তারুণ্যের উপস্থিতির ব্রিগেড সাফল্যে, এবং নবান্ন অভিযানের সংগ্রামী ভূমিকায় উঠে আসবে কি না, তা দেখার। তবে আব্বাসের আইএসএফ- এর সংযুক্ত মোর্চায় যোগদানে বামফ্রন্ট লাভবান তো হয়েছেই। এখানে দু’একটি কথা আছে। ফুরফুরা শরিফেরই আর এক পিরজাদা আব্বাসের কাকা ত্বহা সিদ্দিকি ঘোর বিরোধিতা করছেন ভাইপোর কর্মকাণ্ডের। ত্বহা রয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে। এ ছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ঘুটিয়ারি শরিফ ও আরও কয়েকটি ধর্মস্থানের আলেমরা গড়ে তুলেছেন আব্বাসের ফ্রন্টের বিরুদ্ধ একটি ফ্রন্ট—ইউনাইটেড সেকুলার ফ্রন্ট। এ সব হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে আসাদুদ্দিন ওয়েইসির মিম।


তীব্র মমতা-বিদ্বেষে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির ঝুলির ভোটের হার ৩৭-এ তুলে দিয়েছিলেন সিপিএম দলের ঝাঁক ঝাঁক সমর্থক। তাই বিজেপির ১৮ আসন প্রাপ্তি। এ বার ওই রামের ঘর থেকে সে ভোট বামে ফিরলে, তৃণমূল কংগ্রেসের সুবিধা। কাটমানি, তোলাবাজি, আমপানের ত্রাণের টাকা গায়েব, বেকারি, নিয়োগক্ষেত্রে দুর্নীতি, এ সব অভিযোগে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে অনেকটাই ক্ষোভের ভোট জড়ো হয়েছে। এর অধিকাংশই বিজেপির বাক্সে জমা পড়ে যেত। আব্বাস সহযোগে সংযুক্ত মোর্চা এ ভোটের সিংহভাগ থাবা দিয়ে তুলে নেবে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আব্বাসের ফ্রন্ট বিজেপিকে কিছু আসনে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দেবে।


দলবদল প্রথমে কৌতূহল, তার পর কৌতুকের উদ্রেক করলেও এখন বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এই ঘটনা আমাদের সমাজদেহে পচনের সূচনা করেছে। নির্বাচন এ ব্যাধির নিরাময় নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE