Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবাসী বিপ্লবী ও তাঁদের জাপানি পৃষ্ঠপোষকরা পান কবির সমর্থন
Rabindranath Tagore And Toyama Mitsuru

হোয়ো না ম্রিয়মাণ

১৯০২-এ বাংলার সঙ্গে জাপানের যোগসূত্রটি স্থাপন করে গিয়েছিলেন এশিয়ার ঐক্যের প্রত্যাশী জাপানি নন্দনবেত্তা কাকুজ়ো ওকাকুরা।

ভিন্নপথগামী: তবু জাপানি জাতীয়তাবাদী তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে মিত্রতা ছিল রবীন্দ্রনাথের, টোকিয়ো, ১২ জুন ১৯২৪। সৌজন্য: বিশ্বভারতী।

ভিন্নপথগামী: তবু জাপানি জাতীয়তাবাদী তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে মিত্রতা ছিল রবীন্দ্রনাথের, টোকিয়ো, ১২ জুন ১৯২৪। সৌজন্য: বিশ্বভারতী।

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৩ ০৪:২৯
Share: Save:

একটা অল্প-দেখা ছবিতে রবীন্দ্রনাথের পাশে ঐতিহ্যগত পোশাকে এক জাপানি প্রৌঢ়। ১৯২৪ সালে জাপানে তোলা এই ছবির জাপানি ব্যক্তিটির পরিচয় জানলে অবাক হতে হয়। ইনি এমন এক জন যাঁকে গবেষক স্টিফেন হে অভিহিত করেছেন আধুনিক জাপানের রাজনৈতিক হত্যার সন্ত হিসাবে। ‘সামুরাই’ বংশোদ্ভূত এই জাতীয়তাবাদী নেতার নাম তোয়ামা মিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪)। পরাধীন ভারতবর্ষের প্রতি তোয়ামার সহানুভূতি আর জাপানে আত্মগোপনকারী ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রতি তাঁর সমর্থনের রুদ্ধশ্বাস ইতিবৃত্ত আমরা মনে রেখেছি কি?

১৯০২-এ বাংলার সঙ্গে জাপানের যোগসূত্রটি স্থাপন করে গিয়েছিলেন এশিয়ার ঐক্যের প্রত্যাশী জাপানি নন্দনবেত্তা কাকুজ়ো ওকাকুরা। ভারতে ওকাকুরার বৈপ্লবিক কাজকর্ম ইংরেজ শাসক ভাল চোখে দেখেনি। ১৯০৫-এ রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপান জয়ী হলে শান্তিনিকেতনে বিজয়োৎসব হয়। সেই সময়, ওকাকুরার সুপারিশে জাপান থেকে আসা জুজুৎসু শিক্ষক জিন্নোৎসুকে সানো ছাত্রদের নিয়ে বিজয়গৌরবে আশ্রম পরিক্রমা করেন। ভাণ্ডার পত্রিকায় জাপানের জয়গান গেয়ে জাপানি ছন্দে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তিনটি ছোট্ট কবিতা।

১৯১৫-য় রবীন্দ্রনাথের জাপানে যাওয়া প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তিনি জাপানে তাঁর ঘোরাফেরার বন্দোবস্ত করবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন র‌্যিউকান কিমুরা এবং একাই কাওয়াগুচি নামে দুই বৌদ্ধ গবেষক এবং পরিব্রাজককে। কেউ কেউ এঁদের জাপান এবং ব্রিটেনের চর হিসাবে মনে করেছেন। তখন লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যা-চেষ্টার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত রাসবিহারী বসু লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। পর্যাপ্ত অস্ত্রের জোগানের চেষ্টায় আছেন। রবীন্দ্রনাথ জাপানে যাচ্ছেন, খবরটা কাগজে পড়ে, কবির আত্মীয় সেজে, পি এন ঠাকুর ছদ্মনামে, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে রাসবিহারী জাহাজে পৌঁছে গেলেন জাপানে। সাংগঠনিক দক্ষতায়, অচিরেই জাপানে গড়ে তুললেন রাজনৈতিক যোগাযোগের অবিশ্বাস্য এক বলয়। গ্রেট ব্রিটেন আর জাপান তখন দুই মিত্র দেশ। ইংরেজ-বিরোধী কাজে ইন্ধন জোগানো জাপানের পক্ষে তাই ছিল অস্বস্তিকর। জাপানে রাসবিহারীর আসল পরিচয় গোয়েন্দাদের কাছে ফাঁস করে দেন এক ভারতীয়ই। সংগ্রামী নেতা লালা লাজপত রাই ১৯১৫-য় জাপানে রাসবিহারীর খোঁজ পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এশিয়াবাদের দাপুটে প্রবক্তা তোয়ামা মিৎসুরু এর আগে চিনের নেতা সান ইয়াৎ-সেন’কে জাপানে আশ্রয় দিয়েছিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের চাপে জাপান সরকার যখন জাপানে আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত আর রাসবিহারীকে প্রত্যর্পণের নির্দেশ জারি করেছে, লালা লাজপত তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তোয়ামা মিৎসুরুর। জাপান সরকারের উপর তখন তোয়ামা এবং তাঁর সমিতি ‘গেন্‌য়োশা’-র বিপুল প্রভাব। তোয়ামাই দুই ভারতীয় বিপ্লবীকে, প্রত্যর্পণের নির্দিষ্ট দিনের আগের রাতে চালান করে দিলেন এক গোপন ডেরায়। বাড়ি ঘিরে রাখা পুলিশ বিপর্যস্ত, হতবাক। এর পর রাসবিহারীর জাপানে থাকা পাকা করতে তাঁর আশ্রয়দাতা সোমা-দম্পতির মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে রাসবিহারীর বিয়েও দেন তোয়ামা।

সমকালীন ইংরেজ গোয়েন্দা ‘রিপোর্ট’ রবীন্দ্রনাথের দুই ভ্রমণসঙ্গী উইলিয়াম পিয়ার্সন আর চার্লস অ্যান্ড্রুজ়কে রেখেছিল সন্দেহভাজনদের তালিকায়। সে বার অ্যান্ড্রুজ় ভারতবর্ষে ফেরার পথে সিঙ্গাপুরে এক ইংরেজ সেনাকর্তাকে জানিয়েছিলেন, জাপানে বিতর্কিত ভারতীয়রা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এলেও কবি তাঁদের প্রতি আগ্রহ দেখাননি। জাপানের ভারতবন্ধু প্রধানমন্ত্রী ওকুমা-র সঙ্গে দেখা হলেও ১৯১৬ সালে রাসবিহারী বা তোয়ামার সঙ্গে জাপানে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতের কথা অজানা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পাঁচ বার জাপান ভ্রমণে রাসবিহারী প্রতি বার নীরবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মনে করার কারণ রয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জাপানি রাজনৈতিক নেতা এবং গদর পার্টির সদস্যদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে যুক্ত— ১৯১৭-য় এমনই মিথ্যা অভিযোগে এক মামলায় তাঁর নাম জড়ালে রবীন্দ্রনাথ সেই খবর জানতে পারেন জাপানের এক সংবাদপত্র থেকে। গদর পার্টির চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী, জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং জাপানের অন্য নেতাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজবিরোধী কার্যকলাপের দাবি করাতেই রবীন্দ্রনাথের এই দুর্ভোগ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন আর জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিগেনোবু ওকুমাকে চিঠি লিখে নিজের প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন রবীন্দ্রনাথ। পরে এই মামলা থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯২৪ আর ১৯২৯-এ জাপানে রবীন্দ্রনাথ রাসবিহারী এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ১৯২৪-এ কবির জাপান-ভ্রমণের সঙ্গী নন্দলাল বসু স্মরণ করেছেন, টোকিয়ো যাবার পথে মাঝপথে ট্রেনে উঠে রাসবিহারী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। নন্দলাল লিখেছেন, রাসবিহারী তাঁকে বলেছিলেন, “কোনও রকম করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পার না আমাকে?” নন্দলালের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের থেকে একটা জোব্বা আর টুপি চেয়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন রাসবিহারী। ভারতে পুলিশি হেনস্থার আশঙ্কায় নন্দলাল বসুকে নিজের ডেরায় নিয়ে যাননি রাসবিহারী। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজরে থাকা আর এক ভারতীয় বিপ্লবী কেশোরাম সাবরবালকে নিজের সচিব করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই আমন্ত্রণের ভিত্তিতে জাপানের ব্রিটিশ দূতাবাসের কাছে ১৯২৯-এ সাবরবাল দেশে ফেরার আবেদন করলে তা খারিজ করে দূতাবাস জানায়, ফেরার চেষ্টা করলে পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। ১৯২৪-এর ১২ জুন টোকিয়োয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তোয়ামা মিৎসুরুর দেখা হলে সভার আগে একটা ঘরে দু’জনে একান্তে কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথ তোয়ামাকে বলেন, “ভারতীয়দের প্রতি আপনি যে সহৃদয়তা দেখিয়েছেন তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।” সেই বিবরণ, হাতে পেয়ে ইয়ং ইন্ডিয়া’য় তা প্রকাশ করেন অ্যান্ড্রুজ়। ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের জাপান-ভ্রমণের সঙ্গী ও স্মৃতিলিপিকার কালিদাস নাগ এবং নন্দলাল বসু কোনও অজ্ঞাত কারণে তোয়ামা-রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ একেবারে এড়িয়ে গিয়েছেন। তোয়ামার জীবদ্দশায় প্রকাশিত এক স্মারক ‘অ্যালবাম’-এ তোয়ামা এবং রবীন্দ্রনাথের ছবিটি ছেপে দাবি করা হয়েছে ১৯২৪-এ এক বারই তাঁদের দেখা হয়। সেখানেই জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ তোয়ামার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে তাঁকে না পেয়ে ১৯২৯-এর ৮ জুন তাঁর জন্য একটা চিঠি লিখে রাসবিহারীর কাছে রেখে এসেছিলেন। আবার, ১৯২৯-এ রবীন্দ্রনাথের জাপান-ভ্রমণের সঙ্গী অপূর্বকুমার চন্দের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে স্টিফেন হে দাবি করেছেন, সে বার জাপানে রবীন্দ্রনাথ যাঁর বাড়িতে ছিলেন, সেই বিত্তবান কাগজ-শিল্পপতি কুনিহিকো ওকুরার মাধ্যমে তোয়ামা প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন। সেই বাড়িতেই তোয়ামা গোপনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। হে এ-ও দাবি করেছেন, ওই বৈঠকে কোরিয়া এবং চিনে জাপানের আগ্রাসী নীতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এবং তোয়ামার তীব্র বাদানুবাদ হয় যার জেরে রবীন্দ্রনাথ তোয়ামাকে বলেন, “আমি আর জাপানে আসব না।” জাপানে তোয়ামার ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত দুর্ধর্ষ জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘ব্ল্যাক-ড্রাগন সোসাইটি’র সভাপতি রিয়োহেই উচিদার রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির খোঁজও বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের অভিলেখ্যাগারে পাওয়া যায়।

জাপানের প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের এবং তাঁদের জাপানি পৃষ্ঠপোষকদের রবীন্দ্রনাথ কার্যত সমর্থন করতেন, হয়তো বা কিছুটা কৌশলেই। ১৯১৫-র শীতের রাতে হেরম্বলাল আর রাসবিহারীকে পুলিশের চোখের সামনে থেকে বেমালুম বেপাত্তা করে দিয়ে এক নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন আধুনিক জাপানি ‘সামুরাই’ তোয়ামা, চাকরি খোয়াবার ভয়ে তাঁর কাছে ছুটে আসা জাপানি পুলিশের কাতর আর্তির উত্তরে বলেছিলেন, তাঁদের চাকরি গেলেও তাতে লাভবান হবে ত্রিশ কোটি ভারতীয়। বুঝতে অসুবিধা নেই, কেন জাপানি জাতীয়তাবাদের কঠিন সমালোচনা করেও, তোয়ামা মিৎসুরুর পাশে ইতিহাসের এক বিরল ‘ফ্রেম’-এ বন্দি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যিনি তাঁর আশ্রমের জুজুৎসু শিক্ষার্থীদের গাইবার জন্য লিখেছিলেন, ‍“সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,/ সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Japan Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE