Advertisement
E-Paper

স্বার্থপর সাধনা নয়, সেবাদর্শ

ধর্মের উপলব্ধির জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাস নেওয়াকে আবশ্যক হিসাবে দেখেননি। নিজের জীবনে সহধর্মিণী সারদা দেবীকে তিনি অত্যন্ত মর্যাদা দিয়েছেন।

স্বামী ত্যাগরূপানন্দ

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫৭
A Photograph of Shri Ramakrishna

শ্রীরামকৃষ্ণ। ফাইল ছবি।

ভারতীয় দর্শনের মূল কথা প্রচার করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, ভারতে ও দেশের বাইরে। কিন্তু ভারতীয় ঐতিহ্যের মূল শিকড় তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে। রামকৃষ্ণের ছোটবেলা কাটে গ্রাম কামারপুকুরে, হুগলি জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। যৌবনের দোরগোড়ায় তিনি হাজির হন নতুন প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে, ভবতারিণীর পুজোতে লেগে যান কিছু দিনের মধ্যেই। ইংরেজ শাসিত ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা, পাশ্চাত্যের ভাবধারার আগমনে নতুন চিন্তার জোয়ার বইছে সেখানে। আশ্চর্যের বিষয়, প্রাচীন পূজা-অর্চনাকে কুসংস্কার ভেবে প্রায় বর্জন করতে চলেছে যে শহর, তারই অনতিদূরে নীরবে সাধনায় ডুবে গেলেন রামকৃষ্ণ। প্রতিমাকে অবলম্বন করেই মানুষ ক্রমে অনন্ত ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে, এই সত্যটি ঠিক ঠিক অনুভব করলেন তিনি। হিন্দুধর্মের সাধনা শেষে ইসলামি, সুফি মত ও খ্রিস্টীয় সাধনাও সম্পন্ন করলেন। বই পড়া এবং বিভিন্ন ডিগ্রি আমাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়। কিন্তু ধর্মের সঠিক মর্ম বুঝতে হলে চাই একাগ্রতা ও পবিত্রতা। রামকৃষ্ণ সেগুলি অবলম্বন করেই, নানা ধর্মমতের সর্বোচ্চ সোপানে গিয়ে পৌঁছলেন।

১৮৯৩ সালের বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ ঘোষণা করেন যে, সব ধর্মই মানুষকে নানা পথ দিয়ে, এক ঈশ্বরের কাছেই নিয়ে যাচ্ছে। কলকাতায় ফিরে এসে, সেখানকার অভিনন্দনের উত্তরে স্বামীজি বললেন, তিনি এক জনের পদতলে বসে শিক্ষা লাভ করেছেন, যাঁর সারা জীবনই হয়ে উঠেছিল নানা ধর্মের এক সম্মেলন।

ধর্মের উপলব্ধির জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাস নেওয়াকেও আবশ্যক হিসাবে দেখেননি। নিজের জীবনেও সহধর্মিণী সারদা দেবীকে তিনি অত্যন্ত মর্যাদা দিয়েছেন। ধনবান মানুষ নিজের সম্পত্তি রেখে যান তাঁর স্ত্রী-পরিবারের জন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের কষ্টার্জিত সাধনার ফল অর্পণ করলেন সারদা দেবীকে। রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত মন্দিরেও তিনি মোট তিরিশ বছরের বেশি থেকে ছিলেন। নারীকে সর্বদা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি, সংসার-বিরাগীর অহঙ্কার তাঁর জীবনে কখনও প্রকাশিত হয়নি।

শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা দেবী ও বিবেকানন্দকে পরবর্তী কালে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তিন স্তম্ভ বলে গণ্য করা হয়। সারা জীবন ধরে ধর্মজীবনের তত্ত্বগুলিকে নিজ জীবনে বাস্তব করে তুললেন রামকৃষ্ণ, সেই তত্ত্বগুলি আধুনিক ভাষায় ব্যাখ্যা করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আর সারদা দেবী সংসারে বাস করেও, পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থতার বাস্তবায়ন দেখালেন। উপনিষদে বলা হয়েছে, ত্যাগের দ্বারা কিছু মানুষ অমৃতত্ব লাভ করেছে। এই কথাগুলোর মানে আধুনিক পৃথিবীতে কী দাঁড়ায়, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখের জীবন দেখে তার পরিচয় পাওয়া যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণের বিভিন্ন দিনের কথোপকথন সঙ্কলন করে রচিত হয়েছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত। ১৮৮২ থেকে শুরু করে ১৮৮৬, তাঁর দেহান্তের বছর পর্যন্ত এই বইয়ে বর্ণিত সময়কাল। দিনপঞ্জির ঢঙে লেখা এই বইটিতে শ্রীরামকৃষ্ণ যেন জীবন্ত হয়ে রয়েছেন। তদানীন্তন বঙ্গসমাজের চিত্রও প্রতিফলিত হয় এই বইয়ের নানা পাতায়। নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি যুবক; কেশবচন্দ্র, বিজয়কৃষ্ণ প্রমুখ ব্রাহ্ম সংস্কারক; বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, গিরিশচন্দ্র আদি সেই যুগের নানা মানুষ মিলিত হচ্ছেন রামকৃষ্ণের সঙ্গে, অজানতে রচিত হচ্ছে এক ইতিহাস। এই সময়ের আগে, রামকৃষ্ণের সাধনার শেষে, তিনি অস্থির হয়ে পড়েছিলেন তাঁর কষ্টার্জিত সাধনার নির্যাস অপরকে জানাতে। দক্ষিণেশ্বরে বাবুদের কুঠিবাড়ির ছাদে উঠে চেঁচিয়ে বলছেন, “ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস আয়।” সেই নিঃস্বার্থ আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়েছে বিশ্বজনীন মনে, তাঁর কাছে ক্রমে উপস্থিত হয়েছে নব্যশিক্ষিত বাঙালিরা। কেশবচন্দ্র সেনের কলমে, ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণ বিষয়ক সংবাদ; স্কটিশ চার্চ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ উইলিয়াম হেস্টি তাঁর ক্লাসে কবিতা পড়াতে গিয়ে রামকৃষ্ণের তদ্গত মনের উল্লেখ করলেন।

তেজীয়ান যুবক নরেন্দ্রনাথ তখন যাতায়াত করে ব্রাহ্ম সমাজে। প্রায়ই যোগ দেন তাঁদের সমবেত উপাসনায়, সঙ্গীত পরিবেশন করেন সমাজের অধিবেশনে। ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা রামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত করতেন। নরেন্দ্রনাথ পরিচিত ছিলেন এঁদের সকলের সঙ্গে। শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রতাপচন্দ্র মজুমদারও রামকৃষ্ণের ঘরোয়া বৈঠকে উপস্থিত থেকেছেন— যেমন থাকতেন কেশবচন্দ্র, বিজয়কৃষ্ণ প্রমুখ। কিন্তু নিজের এক ব্যক্তিগত বিপর্যয়, নরেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণের আরও কাছে নিয়ে আসে। আইনজীবী বাবার হঠাৎ মৃত্যু, সংসারের ভয়াবহ চেহারা প্রকট করে তুলল তাঁর কাছে। এর আগে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণের কাছে গিয়েছেন দার্শনিক প্রশ্নের সমাধানের জন্য। এখন কিন্তু তিনি চাকরির সন্ধানরত এক বিপন্ন যুবক, বেকারত্বের শৃঙ্খল তাঁর স্বপ্নকে চুরমার করতে চায়।

প্রচণ্ড বিপদ মানুষের ভিতরের শক্তিকে প্রকাশ করে। জীবনের এই কঠিন সময়েও নরেন্দ্রনাথ নিজের স্বার্থচিন্তা করতে পারেননি। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুপ্রেরণায় জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্যই কেবল চাইতে পারলেন ভবতারিণীর কাছে— আর্থিক সচ্ছলতা চাইতে পারলেন না। এমনকি যোগশাস্ত্রের সর্বোচ্চ উপলব্ধি ‘নির্বিকল্প সমাধি’ চাইতে গেলে, শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে ‘স্বার্থপর’ বলে তিরস্কার করলেন। নরেন্দ্রনাথকে তো বিশাল বটবৃক্ষের মতো হতে হবে, কত মানুষ প্রাণ জুড়োবে তাঁর ছায়ায় বসে!

প্রচলিত বৈষ্ণবধর্ম ‘জীবে দয়া’ করতে শিক্ষা দিয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু ‘জীব’কে দয়া করার চেয়ে, আরও উঁচু আদর্শের কথা শোনালেন, ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবা’। বললেন যে, মন্দিরে মসজিদে যদি ভগবানের আরাধনা হয়, জীবন্ত মানুষে তা নিশ্চয়ই হতে পারবে। জমিদার মথুরামোহনের সঙ্গে বারাণসী যাওয়ার পথে তিনি নিজেও দেওঘরের দরিদ্র সাঁওতাল মানুষদের মধ্যে অন্নবস্ত্র বিলিয়ে দিলেন। পরবর্তী কালে বিবেকানন্দ এই শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করতেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন’। ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবা’র এই আদর্শ হিমালয় থেকে নেমে আসা ভাগীরথীর মতো প্রবাহিত হল, বহু তাপিত মানুষকে জাগিয়ে তুলল এক নতুন সেবাদর্শে।

Sri Ramakrishna Swami Vivekananda Indian philosophy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy