Advertisement
২৭ জুলাই ২০২৪
Language Issue

ভাষা যাতে না হারায়

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মমতো যে কলেজগুলোতে বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর কথা, সেই কলেজের ছাত্রীরাও শিক্ষকের প্রতি অভিযোগ জানানোর সাহস দেখাচ্ছে, হিন্দি ভাষায় না বোঝানোর জন্য।

আফরোজা খাতুন
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৪ ০৮:৪৪
Share: Save:

১৯ মে ১৯৬১ মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে অসমের বরাক উপত্যকার এগারো জন শহিদ হয়েছিলেন। বাংলা ভাষার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী শাসকের আগ্রাসনের ইতিহাস বহন করে চলেছে বর্তমান বাংলাদেশ। ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি থেকে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, আবার ভাষা-ভিত্তিক রাজনীতি থেকে বাংলাদেশের জন্ম হল। ভাষার উপর শাসক দলের আগ্রাসন একটি চরম রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। বর্তমানে সেই ষড়যন্ত্র জোরদার করার চেষ্টা হচ্ছে ভারতের সর্বত্র। ভাষা-শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের সময় মনে পড়ে যাচ্ছে, কথাবার্তায় বাংলা ব্যবহারের জন্য তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষার কথা, এই কলকাতার বুকেই। ২০১৯ সালে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে কলকাতার পার্ক সার্কাসে মহিলাদের জমায়েতে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। আমি বাংলাতে বলছি। তাঁরা হিন্দিতে উত্তর দিচ্ছেন। তাঁরা বাংলা বোঝেন কিন্তু বলতে পারেন না। তাতে আমার অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু আমার অনর্গল বাংলা বলা কয়েক জন মেনে নিতে পারলেন না। হয়তো তাঁদের ভাষা-আভিজাত্যে আঘাত লাগছিল। কিছুটা কড়া গলায় বললেন, “হিন্দি জানেন না কেন?”

হিন্দি না জানলে জবাবদিহি করতে হয় কলকাতার বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম কলেজেও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মমতো যে কলেজগুলোতে বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর কথা, সেই কলেজের ছাত্রীরাও শিক্ষকের প্রতি অভিযোগ জানানোর সাহস দেখাচ্ছে, হিন্দি ভাষায় না বোঝানোর জন্য। বাংলাভাষী শিক্ষকের এ-হেন আচরণ তাদের চোখে অন্যায় মনে হয়েছে। বিধাননগরের এক চোখের হাসপাতালের এক জন নার্স রোগীর জন্য কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন হিন্দিতে। তিনি বাঙালি সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আমি বাংলায় বুঝিয়ে দেওয়ার আবেদন জানাতেই উনি বিরক্ত হয়ে বিষয়টা বাংলায় বোঝালেন বটে, কিন্তু প্রেসক্রিপশনের যে জায়গাটা বাংলায় লেখা, তার উপর আঙুল বুলিয়ে রাগের সঙ্গে বললেন, “এইটা দেখে নিন। বাংলা ছাড়া তো বোঝেন না।” প্রতি দিন অন্তত আধ-ডজন ফোন আসে নানা কোম্পানির লোভনীয় অফার জানিয়ে। অধিকাংশের মুখে হিন্দি। তাঁরা জানেন, পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করতে গেলে হিন্দি ভাষাতেই কথা বলতে হয়। বাংলা-জানা ‘অশিক্ষিত’ কর্মীকে নিতে কোম্পানিগুলির বড়ই অনীহা।

অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যদি ভাষাকে যুক্ত করা না যায়, তবে সেই ভাষা হারিয়ে যাবে। মৃত্যু হবে সেই ভাষার সংগৃহীত জ্ঞানের। হারিয়ে যাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। তাই ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণির উদ্দেশ্য থাকে, তাদের ভাষা ছাড়া অন্যান্য মাতৃভাষার উপর আক্রমণ হেনে সেই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের সব দিক থেকে পঙ্গু করে দেওয়া। সরকারের এই ভাষা-ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়েই স্বাধীন ভারতে নেমে আসে ১৯ মে। অসম বহুভাষিক রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার ও সরকারি কাজের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করায়, বাঙালি-প্রধান বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার দাবিতে অসহযোগ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় অসম সরকারের পুলিশ।

স্বাধীনতার সময় থেকেই দাবি উঠেছিল, অসম অসমিয়াদের। রাজ্য-ভাষা অসমিয়া করতে হবে। যদিও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। বাঙালি একক বৃহৎ ভাষা জনগোষ্ঠী ছিল অসমে। বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির দেশ পরিচয় প্রসঙ্গে অসমের সুরমা উপত্যকা (বর্তমানে বরাক উপত্যকা) এবং অবিভক্ত গোয়ালপাড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ অসমের সমস্ত বাঙালিকে ‘বহিরাগত’ তকমা লাগিয়ে, তারা ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬০ সালে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা বলে বিল পাশ হয়। ভাষা বিল পাশ হওয়ার পর অসমের বাঙালি ও পাহাড়ি জাতি মিলিত ভাবে এই বিলের প্রতিবাদ করেও কোনও প্রতিকার পেল না। অবশেষে কাছাড় জেলায় শুরু হল বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ১৯ মে ১৯৬১ সালে গোটা জেলায় শুরু হল অহিংস সত্যাগ্রহ। এই অহিংস ভাষা-আন্দোলনের উপর গুলি চললে বিশ্বের মাতৃভাষা মর্যাদারক্ষা আন্দোলনের প্রথম নারী কমলা ভট্টাচার্যের সঙ্গে আরও দশ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৭২ সালে আরও এক জন, এবং ১৯৮৬ সালে দু’জন শহিদ হয়েছেন মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করে। এর পরে বাংলাভাষা স্বীকৃতি আদায় করলেও, অসমিয়াকরণের পন্থা কিন্তু থেমে থাকল না। বাংলা পাঠ্যপুস্তকে অসমিয়া শব্দের ব্যবহার, বাক্যগঠনে অসমিয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে এক মিশ্র ভাষা তৈরি হল। সরকারি নির্দেশনামাতেও বাংলা ভাষাকে বিকৃত করা হল। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা গড়ে তুললেন ‘মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতি’।

বর্তমানে ভারতে কেন্দ্রের শাসক ‘এক দেশ, এক ভাষা’ নীতিতে বিশ্বাস করেন। গত বছর তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন হিন্দি চাপিয়ে দিয়ে আঞ্চলিক ভাষাকে লুপ্ত করে দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম, দক্ষিণ ভারতের এই ভাষা জনগোষ্ঠীও হিন্দি আগ্রাসনের বিরোধিতা করছে। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জাতিসত্তাগত ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। তবেই রোখা সম্ভব অন্য ভাষার আগ্রাসন ও আধিপত্যকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE