—প্রতীকী ছবি।
যূথবদ্ধতার নির্বোধ আস্ফালন চার দিকেই দেখা যাচ্ছে। এক সঙ্গে ঘোঁট পাকানোর কিছু বাড়তি সময় ক্ষমতার একটা স্বাদ দেয়। সেটা ঠিক ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার মতো অনুভব। পিটুলিগোলার রোয়াব। যূথবদ্ধতা থেকে যৌথতার দূরত্ব অনেকখানি। সে যৌথতার ভেক ধরে। ঐকমত্যের মুখোশের আড়ালে, আনুগত্যের শর্ত আরোপ করে, অন্যকে অপমান করে তার সমর্পণ দাবি করে।
কঠোর, অসংবেদনশীল, বিষাক্ত পৌরুষ পরীক্ষা নেয়, কে কতটা ‘পুরুষ’ হয়ে উঠল। আর যে পৌরুষ এখনও ততটা অশ্লীল ক্ষমতার দাপট দেখাতে অভ্যস্ত হতে পারেনি, সে লজ্জায় মুখ লুকোয়। অভিযোগ করলে পৌরুষের ভাগে আরও একটু কম পড়তে পারে যে! ফলে, একটা ঘটনার সুতো ধরে, আরও অন্য সমস্ত ঘটনার কথা বেরোতে থাকে। জানা যায়, এই ঘটনা হয়েই আসছে। এই ‘ঐতিহ্য’-এর পাশাপাশি, বৃহত্তর সামাজিক-গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছিল, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে মিছিল, প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন পরিচিতির দাবির প্রতি সমর্থনে ‘প্রাইড মার্চ’ ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে অনুজ সহপাঠীদের উপর দলবদ্ধ ভাবে চড়াও হওয়াটাও ছিল। অন্যকে খাটো দেখাতে তাকে প্রান্তিক যৌন পরিচিতির মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল। মফস্সলের পরিচিতিকে বিষাক্ত শহুরেপনার নিজের মতো গড়েপিটে নিয়ে ‘দুনিয়াদারি’-র পাঠ দেওয়া— এগুলোও ছিল।
একটা থাকলে অন্যটা থাকবে না, এমন ভাবা ভুল। কারণ উল্টো দিকে একটা ভাষ্য তৈরি হওয়ার বিপদ থাকে যে, ওগুলো ছিল বলেই এগুলো আছে। তাই বৃহত্তর সামাজিক দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা বাতিল করার দাবিও তৈরি হতে পারে। আজকের রাজনীতিবিমুখ সময়ে, অভিজাত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে তা সহজেই বৈধতা পাবে, পেতে শুরুও করেছে অল্পবিস্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যূথবদ্ধতাকে কেন যৌথতায় উন্নীত করা সম্ভব হচ্ছে না, কেন প্রাতিষ্ঠানিকতার অনুকরণেই ক্ষমতা প্রদর্শনের বদভ্যাসগুলো থেকে যাচ্ছে, কেন বিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুশীলনের মধ্যেও প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির গাদগুলো থেকে যাচ্ছে, পরিবার-প্রতিবেশ-আশৈশব সমাজ কেন হয় দাপটের পৌরুষ অথবা দাপুটে না হওয়ার লজ্জাকেই লালন করেছে— এই প্রশ্নগুলো তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।
ক্ষমতা জাহির করাটা একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সব সময় সে ক্ষমতা যে সাংঘাতিক কিছু ফলদায়ক হবে, এমনটা না-ও হতে পারে। সমাজমাধ্যমে মতের ন্যূনতম অমিল হলেও কাউকে অপমান করার রেওয়াজ (খানিক তত্ত্বকথা শুনিয়ে দেওয়া, দুটো ভারী বইয়ের নাম উল্লেখ করা) তো হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। অফিস-কাছারি, সরকার, কর্পোরেট, পরিবার-পাড়া-গ্রাম-মফস্সল— সর্বত্রই আছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে সমাজমাধ্যমে। মুখোমুখি কথা বলার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না বলেই, সেখানে অনেক বেশি প্রগল্ভ হওয়ার সুযোগ থাকে।
ক্ষমতার আধিপত্যকে মেনে নেওয়া, তাকে বইতে বাধ্য করার অভ্যাস আমাদের মধ্যে তৈরি করা হয়। মেধা যেমন একটা কল্পিত নির্মাণ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটকে তা কুশলী শ্রমের উপরে স্থাপন করে। শহরকে গ্রামের উপরে, সম্পন্নতাকে দারিদ্রের উপরে, পুরুষকে নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের উপরে জায়গা করে দেয়। কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সেই অভ্যাস-প্রস্তুতি প্রক্রিয়ার বাইরে থাকবে, এটা কতটা সম্ভব? বরং ভাবতে হবে, বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরা পাশ করে বেরোন, তাঁদের অধিকাংশ পরবর্তী জীবনে কী করেন, কোথায় যান? যাদবপুরে আগুনে আন্দোলনের যোগদানকারীদের যাঁরা পেশাসূত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যোগ দেন, তাঁদের বেশির ভাগ কি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ইউনিয়নের পক্ষে সওয়াল করেন? কর্মনিযুক্তির যে কোনও ক্ষেত্রেই, ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে মুষ্টিমেয় অংশ কথা বলেন, তাঁদের মধ্যে কত জন এলিট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এসেছেন? বিশ্ববিদ্যালয়-পরবর্তী জীবনে, তাঁদের বেশির ভাগই কি ক্ষমতাকে, প্রতিষ্ঠানকে সেবা করেন না? তার জন্য তাঁদের ছাত্রবয়সের রাজনৈতিক সক্রিয়তাগুলোকেই বাতিল করে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়।
তেমনই, যাদবপুর, কলকাতা, প্রেসিডেন্সির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করবেন, তার মধ্যে দুর্বলের উপর ক্ষমতা প্রয়োগের অভ্যাস, অন্যের সম্মতির তোয়াক্কা না-করার চেষ্টা থাকবে না, এমন প্রত্যাশারও কারণ নেই। বরং ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা এই ব্যাধিগুলো সারাতে সাহায্য করবে, এটা প্রত্যাশিত। প্রতিষ্ঠানের আভিজাত্যের বড়াই ছাত্রদের উপর বাড়তি রাজনৈতিক দায়িত্ব বর্তায়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অর্জনগুলো বজায় রাখতে ছাত্রদের থেকে বাড়তি দায়িত্ব প্রত্যাশা করে সমাজ। দায়িত্ব নিতে না পারলে, খেসারত দিতে হবে।
ছাত্র-রাজনীতিকে ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী অবস্থান হিসাবে না দেখে, দলীয় রাজনীতির প্রসারণ হিসাবে দেখলে, ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জের বদলে দোষীদের আড়াল করা হয় বেশি। দোষীদের শাস্তিবিধান প্রয়োজন। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তির মোহে আমরা যেন ছাত্রসমাজের সামাজিক-রাজনৈতিক সক্রিয়তার উপর ভরসা রাখতে ভুলে না যাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy