Advertisement
০৩ মে ২০২৪
জনসমাজ কী চায়, সেই চাহিদার অর্থই বা কী
Protest

কথা শোনার রাজনীতি

যদি বলি পশ্চিমবঙ্গে তেমন জনজাগরণ দেখা যাচ্ছে, সেটা কেবল অত্যুক্তি হবে না, তাতে মন-ভোলানো আশাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে।

আন্দোলনের অধিকার দিন দিন লুপ্ত হচ্ছে।

আন্দোলনের অধিকার দিন দিন লুপ্ত হচ্ছে।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২২ ০৬:০৯
Share: Save:

যত দিন যাচ্ছে, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় বাড়ছে। চাকরি নেই, আন্দোলনের অধিকারও দিন দিন লুপ্ত হচ্ছে।... ইন্টারভিউ না দিয়ে চাকরি পাওয়ার দাবিটা আমি সমর্থন করি না। কিন্তু সেটা বুঝিয়ে বলে আন্দোলন তোলা যেত।... টেট-উত্তীর্ণ ছেলে-মেয়েগুলোকেও চাকরি দেওয়ার নামে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এখন উল্টে অধিকারের লড়াই থেকে জোর করে উৎখাত করে দেওয়া হচ্ছে।... এই ভাবে যে কোনও আন্দোলন তুলে দেওয়া যায়, ভাবতেই পারছি না।... প্রশাসনের লোকজনের কি সামান্য সহানুভূতিও নেই?... অনশনের মতো আন্দোলনকে বলপ্রয়োগ করে তুলে দেওয়ার এমন ঘটনা অতীতে বহু ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, যে সরকারই এই কাজ করেছে, তার শেষের শুরু হয়ে যায় সেই মুহূর্ত থেকেই।”

—কথাগুলো এক জনের নয়, মহানগরের ছ’জন নাগরিকের। তাঁরা কেউ শিক্ষার্থী, কেউ শিক্ষক, কেউ সরকারি কর্মী, কেউ গৃহিণী। গত শনিবার এই পত্রিকার ‘কলকাতা’ বিভাগে প্রকাশিত তাঁদের মন্তব্যগুলি থেকে নির্বাচিত কয়েকটি বাক্য বা বাক্যাংশ বেছে নিয়ে পর পর রেখে পড়তে গিয়ে মনে হল, যেন এক জনেরই বক্তব্য। অথচ বলে রাখা দরকার, সকলের সব মত এক নয়, বরং স্বতন্ত্র এবং বিভিন্ন অবস্থান থেকেই যে যার কথা বলেছেন। কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্য নিয়েই তাঁরা, যেন একটি সাধারণ নৈতিক বনিয়াদের উপর দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে, অন্যায়কে অন্যায় বলে শনাক্ত করেছেন। দৃশ্যত, ন্যায়-অন্যায়ের স্বাভাবিক বোধ তাঁদের বলে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই আচরণ করতে পারে না। এখানে একটা সংহতির আভাস আছে। নৈতিকতার সংহতি।

এই সংহতি এখন আমাদের খুব দরকার। গত বৃহস্পতিবার সেটা ভয়ানক ভাবে টের পাওয়া গেল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘আন্দোলনকারীদের ভালবাসি, যাঁরা ন্যায্য আন্দোলন করেন।’’ এমন অবান্তর উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গকৌতুক করলেও তাকে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সত্যিকারের প্রতিবাদকে আমাদের রাষ্ট্রশক্তির যে কখনওই ‘ন্যায্য’ মনে হবে না সেটা বিলক্ষণ জানা আছে, ক্ষমতার মালিকদের কাছে ও-সব ভালবাসা-টালবাসা কেউ চায়ওনি। যাঁরা আকণ্ঠ দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির কারণে অন্যায় ভাবে বঞ্চিত হওয়ার প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছেন, শাসকেরা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে শিখলেই নাগরিকরা বাধিত হতেন। কিন্তু সেই শিক্ষা তো বহু জন্মের সাধনার ব্যাপার। সুতরাং, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওই ভালবাসা বিষয়ক সুসমাচারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কৃষ্ণা একাদশীর ঘোরা রজনীতে পুলিশ এসে অনশনরত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে টেনেহিঁচড়ে উঠিয়ে দিল, ধরে নিয়ে গেল এবং এই পীড়নের প্রতিবাদ করতে গেলে প্রতিবাদীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আরও এক বার উন্মোচিত হল প্রতাপ-অন্ধতার উৎকট প্রতিমা। এটাই সেই সময়, যখন রাষ্ট্রশক্তির মুখের উপর সমস্বরে বলা দরকার: এই অনাচার চলতে পারে না। ১৪৪ ধারা, আইন, আদালত, পদ্ধতি, প্রক্রিয়ার ষোড়শোপচার নিয়ে বহু মত থাকতে পারে, বহু তর্ক উঠতে পারে, কিন্তু নিরস্ত্র, অহিংস আন্দোলন ভাঙতে এই ভাবে চড়াও হওয়ার নৈতিক অধিকার কোনও সরকারের নেই। প্রশ্নটা আইনের নয়, নৈতিকতার।

প্রতিবাদ এবং প্রতিস্পর্ধা তখনই প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যখন তা লোকসমাজ থেকে উঠে আসে। বিরোধী রাজনৈতিক দল বা তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন ও গোষ্ঠী সেই প্রতিবাদকে সংহত করতে পারে, তার ব্যাপ্তি ও গভীরতাকে প্রসারিত করে প্রতিস্পর্ধাকে জোরদার করে তুলতে পারে, সেটাই তাদের দায়িত্ব; কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহারের প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে জনসমাজের স্বাভাবিক ন্যায়বোধের থেকে বড় শক্তি আর কিছু নেই। সেই বোধ যখন জাগ্রত ও সংগঠিত হয়, তখনই বহু দিন ধরে মার-খাওয়া মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার উদ্দেশে কঠোর সত্য উচ্চারণ করেন, সমবেত প্রত্যয়ের স্বরে জানিয়ে দেন: অনাচারের পাহাড় পেঁজা তুলোর মতো উড়ে যাবে— হম দেখেঙ্গে।

যদি বলি পশ্চিমবঙ্গে তেমন জনজাগরণ দেখা যাচ্ছে, সেটা কেবল অত্যুক্তি হবে না, তাতে মন-ভোলানো আশাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। কিন্তু সমাজের বহু মানুষের চেতনায় যে নৈতিকতার সংহতি সেই জাগরণের প্রাথমিক শর্ত, তার লক্ষণগুলি ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে এ-রাজ্যে শাসক বামফ্রন্ট বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার পরে প্রয়াত অর্থনীতিবিদ কল্যাণ সান্যাল এই পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘সমাজের যৌথ নীতিবোধকে আঘাত করলে সমাজ একসময় নির্মম প্রত্যাঘাত করে।’’ তার দু’বছর পরে সেই প্রত্যাঘাত আরও বড় আকারে আছড়ে পড়েছিল। তার পরে প্রায় এক যুগ অতিক্রান্ত। ইতিহাস ফিরে আসে না, কিন্তু ইতিহাস থেমেও থাকে না। এই এক যুগে সমাজের ‘যৌথ নীতিবোধ’ নিশ্চয়ই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। বিশেষত সরকারি ভান্ডার থেকে নির্বিচারে প্রসাদ বণ্টনের ধারায় অধিকারসচেতন নাগরিককে অনুগ্রহপ্রার্থী প্রজায় পরিণত করবার প্রকল্পটি হয়তো অংশত সফল হয়েছে। কিন্তু শাসকরা যদি ধরে নিয়ে থাকেন যে জনসমাজের নৈতিকতার ব্যাকরণ স্কুলের পাঠ্যবইয়ের মতো পাল্টে দেওয়া যায়, তা হলে বুঝতে হবে তাঁরা দেওয়ালের লিখন পড়তে পারছেন না বা চাইছেন না।

বিরোধীরা পড়তে পারছেন কি? নির্বাচনী পাটিগণিতে যারা এ-রাজ্যে প্রধান বিরোধী শক্তি, এই আলোচনায় তারা অপ্রাসঙ্গিক। প্রথমত শাসক দলের সঙ্গে তাদের বিচিত্র আসা-যাওয়ার সম্পর্ক, দ্বিতীয়ত বিরোধিতার নামে থেকে থেকে উৎকট শোরগোল ও লাফঝাঁপ করার রীতি, এবং সর্বোপরি তাদের সর্বনাশা সংখ্যাগুরুবাদ, সমস্ত কারণেই অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)? তাঁদের সম্পর্কে সংশয় অনেক, অভিযোগ বিস্তর। অতীতের ভ্রান্তি এবং অন্যায় তাঁরা আজও সৎসাহসের সঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেননি, তাঁদের নেতা-কর্মীদের অনেকের আচরণেই এখনও সেই অতীতের দাম্ভিক উত্তরাধিকার প্রকট। সে জন্য কঠোর সমালোচনা তাঁদের প্রাপ্য, আত্মসংশোধনের জন্য তাঁদের উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাওয়াও জরুরি। কিন্তু রাজনীতি মান-অভিমানের ব্যাপার নয়, রাজনীতি মানে নিরন্তর সংগ্রাম। যে প্রকরণ হাতে আছে তা দিয়েই সেই লড়াই লড়তে হয়, ‘সে পার্টিও নেই সেই নেতৃত্বও নেই’ বলে হা-হুতাশ করা বাস্তববোধের পরিচয় দেয় না। বাস্তব রাজনীতির নিজস্ব প্রয়োজনে এবং যুক্তিতেই পশ্চিমবঙ্গের এই অদ্ভুত আঁধারে সিপিআইএমের মতো দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণেই একটা বড় প্রশ্ন হল, দলের নেতা ও কর্মীরা কি বাঁধা বুলি ও ছকের বাইরে গিয়ে নতুন রাজনীতি ভাবতে পারবেন? ভাবতে চাইবেন?

এই মুহূর্তে শাসকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং প্রতিবাদের অধিকার হরণে রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তাঁদের যে সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে, সেটা জরুরি। কিন্তু যথেষ্ট নয়। প্রতিস্পর্ধী বাম রাজনীতিকে তাঁদের নতুন করে গড়তে হবে, তার ভিত্তিতে নিজস্ব নীতি ও কর্মসূচি তৈরি করে প্রত্যয়ের সঙ্গে জনসমাজের সামনে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সেই নবনির্মাণের কাজটি পার্টির লোকেরা করে ফেলবেন এবং জনসাধারণকে তা বুঝিয়ে দেবেন— এই পুরনো অহঙ্কার বিসর্জন দেওয়া দরকার। সিপিআইএমের নেতৃত্ব নভেম্বর মাসে গ্রামে গ্রামে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ করছেন। জনসংযোগ অবশ্যই দরকারি। কিন্তু প্রকৃত সংযোগ মানে কেবল নিজেদের কথা প্রচার করা নয়, শ্রমজীবী মানুষের কথা মন দিয়ে শোনা এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেওয়া। তাঁদের চাহিদা ও দাবিগুলো জানা দরকার, কোন অবস্থান এবং ধারণা থেকে সেই চাহিদা উঠে আসছে সেটা বোঝা দরকার। অনুধাবন করা দরকার, তাঁরা নিজেদের অধিকার বলতে আজ কী বোঝেন। সেই বোধকেই অভ্রান্ত মনে করার কোনও কারণ নেই, তা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথোপকথন চালাতে হবে বিভিন্ন পরিসরে, বিভিন্ন স্তরে। এবং তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের সঙ্গে কাজ করে, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের সক্রিয় অংশীদার হয়েই প্রকৃত কথোপকথন সম্ভব। কথায় ও কাজে সেই ‘যুক্ত সাধনা’র মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি গড়ার পথে এগোতে পারলে হয়তো ‘সমাজের যৌথ নীতিবোধ’-এর তল পাওয়া যাবে। সেটাই আবার জনসমাজের আস্থা ফিরে পাওয়ার প্রথম শর্ত। কাজটা কঠিন। কিন্তু কাজটা বামপন্থী রাজনীতির পক্ষেই সম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Protest Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE