E-Paper

লিঙ্গসাম্যের পথ অনেক লম্বা

২০২২ সালের হিসাবে ভারতীয় মেয়েদের স্বাস্থ্যের হাল গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম। এর কারণ এক কথায় কন্যাভ্রূণ হত্যা।

প্রহেলী ধরচৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:০৯
A Photograph representing Gender Equality

কর্মক্ষেত্রে যোগদানে এ দেশের মেয়েদের অবস্থান ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৪৩তম। প্রতীকী ছবি।

বছরখানেক আগের কথা। নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সম্মেলনে প্রশ্ন করা হল, “বিশ্ব জুড়ে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে আনুমানিক আরও কত বছর লাগতে পারে বলে আপনার ধারণা; কুড়ি, পঞ্চাশ, আশি, না দু’শো বছর?” দেখা গেল, অধিকাংশই মনে করছেন, আগামী পঞ্চাশ বছরে বিশ্ব জুড়ে লিঙ্গসমতা প্রতিফলিত হবে। সে আশায় জল ঢেলে সভাপতি যখন জানালেন, আগামী অন্তত দু’শো বছরের আগে এ ধরাধামে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনাই বিশেষজ্ঞরা দেখতে পাচ্ছেন না, তখন প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে গুনগুন, ফিসফাস।

তার কয়েক মাস আগেই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদন। ১৪৬টি দেশের উপর করা সমীক্ষাটি বলছে, বিশ্ব জুড়ে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠিত হতে গড়পড়তা একশো বত্রিশ বছরের মতো সময় লাগবে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও লাটিন আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে যেখানে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা হতে আনুমানিক আর ষাট-পঁয়ষট্টি বছর লাগবে, সেখানে সাব-সাহারা আফ্রিকা ও উত্তর আফ্রিকায় সময় লাগবে একশো সাত বছরের মতো। সবচেয়ে বেশি সময় লাগবে এশিয়ায়। মধ্য ও পূর্ব এশিয়াতে সময় লাগবে যথাক্রমে দেড়শো ও একশো সত্তর বছর। আর সবাইকে ছাপিয়ে ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে লাগবে অন্তত দু’শো বছর।

চিন্তার ব্যাপার হল, কোনও দেশের লিঙ্গসমতা মাপার যে চারটি প্রামাণ্য স্তম্ভ, মেয়েদের স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার, শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, তার সব ক’টি ক্ষেত্রেই ভারত অনেক পিছিয়ে। যেমন ২০২২ সালের হিসাবে, ভারতীয় মেয়েদের স্বাস্থ্যের হাল গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ, ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম। এর কারণ এক কথায়, কন্যাভ্রূণ হত্যা। কন্যাভ্রূণ হত্যার কারণে মেয়েদের জন্মকালীন অসম লিঙ্গ-অনুপাত-ই এ দেশের মেয়েদের স্বাস্থ্যখাতে গোটা বিশ্বের মধ্যে সর্বশেষ অবস্থান দখলের কারণ। পিউ রিসার্চ সেন্টারের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখাচ্ছে, গত উনিশ বছরে এ দেশের ‘মিসিং গার্ল’-এর সংখ্যা অন্তত নব্বই লক্ষ; গোটা উত্তরাখণ্ডের জনসংখ্যার প্রায় সমান। গর্বিত বর্ণহিন্দু জনজাতি জানলে অবাক হবেন, এই ‘মিসিং গার্ল’-এর প্রায় নব্বই শতাংশই হিন্দু; সংখ্যার বিচারে প্রায় আশি লক্ষ। অর্থাৎ, এ দেশের ৯০ শতাংশ ‘মিসিং গার্ল’-এর দায় এসে পড়ছে সাড়ে ঊনআশি শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর। এর পরেই রয়েছে শিখ জনগোষ্ঠী। ২ শতাংশেরও কম এই জনগোষ্ঠীর কাঁধে রয়েছে ৫ শতাংশ ‘মিসিং গার্ল’-এর দায়। এ দেশের চোদ্দো শতাংশ মুসলিম ও আড়াই শতাংশ খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীদের ঘাড়ে রয়েছে যথাক্রমে সাড়ে ছয় শতাংশ ও ১ শতাংশেরও কম ‘মিসিং গার্ল’-এর দায়। অর্থাৎ, সংখ্যালঘুর অবস্থান সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর থেকে এ ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে।

কর্মক্ষেত্রে যোগদানে এ দেশের মেয়েদের অবস্থান ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৪৩তম। ভারতের পিছনে রয়েছে কেবল ইরান, পাকিস্তান ও তালিবান-অধিকৃত আফগানিস্তান। দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের অসম বা কম বেতন লাভ, ঘরসংসারের তাগিদে পদোন্নতিতে অনীহা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার অভাব এ দেশের মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যে কারণটি মূলগত, তা হল কর্মক্ষেত্রে যোগদানে অনীহা। সনাতন মূল্যবোধের পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হারের ধারাবাহিক ওঠাপড়া লক্ষ করলেই দেখা যায়, ভারতে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যোগদান মূলত অর্থনৈতিক প্রয়োজনভিত্তিক এবং এর সঙ্গে মেয়েদের শিক্ষার সম্পর্কটি স্পষ্ট ও কার্যকারণ-সম্পর্কিত নয়। দেখা গিয়েছে, যখনই দেশ অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখনই মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার বাড়ছে। কোভিডকালেও এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। চিন্তার কথা। কারণ যে উত্তরণ নিতান্ত প্রয়োজনের, প্রয়োজন মিটলেই তা অদৃশ্য হয়, সুদূরপ্রসারী ফল না দিয়েই। তাই দীর্ঘমেয়াদে মেয়েদের কাজের বাজারে যুক্ত করতে হলে আগে প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতাগুলি দূর করা। পাশাপাশি, মেয়েদের উচ্চ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সুযোগ বৃদ্ধি ঘটলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া সম্ভব।

মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এ দেশের মেয়েদের অবস্থান বিশ্বে ১০৭তম। প্রাথমিক শিক্ষায় নথিভুক্তির হারে ভারত উল্লেখযোগ্য ভাবে পিছিয়ে। সাক্ষরতার হারের বিচারেও ভারত এখনও বেশ পিছিয়ে। বিশ্বে এই হার যখন ২০২২ সালের প্রায় ৮০ শতাংশ, ৭০ শতাংশ সাক্ষরতার হার নিয়ে ভারত বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১২১-এ।

একমাত্র মেয়েদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের স্থান উল্লেখযোগ্য, বিশ্বে ৪৮। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের বাজার বা রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বাংলাদেশের মেয়েদের অবস্থান গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ন’টি দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম এবং বিশ্বে ৭১তম। প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার এই তো সেরা সুযোগ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy