E-Paper

থিম পুজোর পিলসুজ

প্যান্ডেলের কাজ শেষ হয়ে গেলে প্যান্ডেল-শ্রমিক বা কারুশিল্পী-শ্রমিক, কেউই আর শহরে থাকেন না, ছোটেন দেশের বাড়ি। এই শহরে অতিরিক্ত একবেলা মাথা গোঁজা, খাওয়ার জন্যও গাদাখানেক টাকা গুনতে হয়।

অভিজ্ঞান সরকার

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৩৭
An image of pandal workers

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

দেবী বাপের বাড়ি আসার বহু আগেই গাঁ-গঞ্জ থেকে প্যান্ডেল-শ্রমিকরা শহর কলকাতায় চলে আসেন। ভগীরথ পতিত মহালয়ার কুড়ি দিন আগে ক্যানিং-এর বাড়ি ছেড়ে এসেছেন, প্রতি দিন আটটা থেকে লেগে পড়েন বাঁশ আর বাটাম দিয়ে অস্থায়ী ইমারতের কাঠামো তৈরি করতে, কাপড় লাগাতে। বাঁশের নড়বড়ে জোড়গুলোয় ভর দিয়ে অবলীলায় চার তলা উচ্চতায় স্পাইডারম্যানের মতো উঠে যাচ্ছেন ভগীরথ, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে হেলদোল নেই তাঁর। গত দুই দশক বাঁশ বেঁধে, পেরেক ঠুকে, ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ঝুলে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। দুর্ঘটনার বিমা কিছু নেই, দেবীর কৃপাদৃষ্টির উপর ভরসা। তিন তলা সমান উঁচু খোলা প্যান্ডেলের টঙে বসে বিড়ি ধরিয়ে একটু জিরিয়ে নেন। এক প্যান্ডেলে কাজের শিফট শেষ করে অন্য প্যান্ডেল ধরতে হবে।

ভগীরথের নীচে কাজ করেন আরও জনা আষ্টেক সুন্দরবনের লোক। দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে দুটো শিফট। ভগীরথ প্রতি শিফটে পাঁচশো টাকা মজুরি পান, হেল্পার সুশান্ত হালদারের জোটে ৩৭৫ টাকা। সুন্দরবনের সামান্য দিনমজুরির তুলনায় রোজ ৭৫০ থেকে হাজার টাকা অনেক রোজগার। মীন ধরতে ধরতে, বর্ষায় চাষের কাজ করতে করতে সুশান্তরা অপেক্ষা করেন— ঠিকাদারদের থেকে খবর পেলেই প্যান্ডেলের কাজে হাজির হন কলকাতা। সম্বৎসর উপার্জনের খামতি পুষিয়ে নেওয়ার একটাই পথ। সারা দিন কাজ, রাতে ডেরা ডেকরেটরের সরঞ্জাম রাখার গুদাম। দুপুরের খাবার পাইস হোটেলে, রাতে বাড়ি ফিরে নিজেরাই হাঁড়ি চড়ান, খরচা বাঁচে।

ডেকরেটর সংস্থাগুলি গ্রাম থেকে আনেন যে শ্রমিকদের, প্রধানত ছোট ও মাঝারি বাজেটের আয়তাকার মন্দিরের আদলে প্যান্ডেল তৈরি করেন তাঁরা। থিম পুজোর ক্ষেত্রে বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি মজুরির জন্যই বরাদ্দ থাকে। প্যান্ডেল-শ্রমিকদের সঙ্গে নানা শিল্পসামগ্রী তৈরিতে দক্ষ সহায়ক কারুশিল্পীরা ভাদ্র মাসে বা তারও আগে কলকাতা চলে আসেন। ঢোকরা, মুখোশ, পুতুল, শীতলপাটি, মাটির ফলকচিত্র, পাতা ও খড়ের পট— শুধুমাত্র প্যান্ডেল নয়, প্যান্ডেল ছাড়িয়ে পাড়ার প্রবেশদ্বার অবধি জায়গার সজ্জা পরিকল্পনা করতে হয় শিল্পীকে। কলকাতার থিম পুজোগুলিতে প্যান্ডেল ও শিল্পী শ্রমিক মিলিয়ে কাজ করেন গড়ে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ জন, বাজেট অনুযায়ী। মূল শিল্পীর নির্দেশ মতো দক্ষ-অদক্ষ শিল্পীরা মিলে কারুসামগ্রী নির্মাণ করেন শয়ে শয়ে, কয়েক মাসের শ্রমে দেওয়ালে ফুটিয়ে তোলেন বিস্ময়।

বাসন্তীর সুরজিৎ মণ্ডল দশ জন শ্রমিক সহকর্মীর সঙ্গে গত দু’মাস ধরে দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী পুজোর মণ্ডপে ঘাঁটি গেঁড়েছেন। এই পুজোটির দুর্গা মূর্তি ও মণ্ডপ প্রায় ম্যুরালের মতো। সুরজিৎ গর্বের সঙ্গে বলছিলেন কী ভাবে মঞ্চ ও মূল কাঠামোটি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তাঁরা গড়েছেন থিম শিল্পীর চাহিদামত। নিখুঁত কাঠামো নির্মাণে ট্রাস-এর অঙ্ক করতে হয় প্রযুক্তিবিদদের। সুরজিৎ, ভগীরথরা অভিজ্ঞতালব্ধ কারিগরির ধারণার সাহায্যেই ময়দানবের মতো ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ করে চোখ ধাঁধিয়ে দেন। সুরজিতের সঙ্গে পুজো কমিটির দৈনিক হাজার টাকার চুক্তি হয়েছে, কাজের সময় মাপা নেই, রাত বারোটা অবধিও কাজ করতে হতে পারে। অস্থায়ী ডেরায় রাঁধুনি আছেন, খাওয়ার খরচ কমিটির।

সুরজিৎদের সঙ্গে রয়েছেন অমিত মালিক, থিমের পরিকল্পনাকারী মূল শিল্পীর সহায়ক রূপে, সঙ্গে বলাগড়ের আরও ছ’জন। যাবতীয় সজ্জার কাজ তাঁরা করছেন গত দু’মাস ধরে। অমিত রাজমিস্ত্রি, বছরের অন্য সময়ে মজুরি দৈনিক ৪৫০ টাকা। থিম পুজোর হাজার টাকা রোজের চুক্তি খুবই লোভনীয় তাঁর কাছে। তার, সুতো, শোলার কাজ গত দশ বছরে শিখে নিয়েছেন অমিত। আবার প্যান্ডেল কাঠামোর প্রয়োজন মতো গাঁথনির কাজও করে দেন। অমিতের দলে বেত ও বাঁশের কঞ্চির কাজের দক্ষ শ্রমিক আছেন। পরিবারের মতো একটা টিম তৈরি হয়েছে তাঁদের। শ্রাবণ মাসে শিল্পী ডেকে নেন কলকাতায়, থিমের রূপায়ণে ঝাঁপিয়ে পড়েন দল বেঁধে।

কলকাতাতে প্রায় তিন হাজার দুর্গাপুজো হয়, থিমের পুজোর সংখ্যা প্রায় পাঁচশো। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজোর অর্থনীতি পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকারও বেশি এবং ক্রমবর্ধমান। ভক্তি ও পুঁজির অভিনব সংমিশ্রণ এই পুজো পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি-তে প্রায় তিন শতাংশ অবদান রাখে। শহরের পাড়া ও ক্লাবের ‘শারদ সম্মান’ শিরোপা অর্জনের প্রতিযোগিতা ধুঁকতে-থাকা গ্রামের কৃষিশ্রমিক ও কারুশিল্পীদের খানিক বাঁচার রসদ জোগায়, বাড়তি উপার্জন দেয়।

প্যান্ডেলের কাজ শেষ হয়ে গেলে প্যান্ডেল-শ্রমিক বা কারুশিল্পী-শ্রমিক, কেউই আর শহরে থাকেন না, ছোটেন দেশের বাড়ি। এই শহরে অতিরিক্ত একবেলা মাথা গোঁজা, খাওয়ার জন্যও গাদাখানেক টাকা গুনতে হয়। তিলে-তিলে গড়ে তোলা ওই গজদন্ত মিনার, প্যান্ডেল, দর্শকের উচ্ছ্বাস সবই যেন অলীক হয়ে যায় শহর ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। কোনও শারদ সম্মানে, পুরস্কার বিতরণীতে এই শ্রমিকরা যোগ দেন না, কোনও শিল্পকর্মে স্বাক্ষর থাকে না তাঁদের। ভগীরথ পতিত বলছিলেন, প্যান্ডেল বাঁধার সময়ে সামান্য ভুলচুক হলেই কাজের মালিক, কর্মকর্তারা তেড়ে গালিগালাজ করেন। “দেবতা বিশ্বকর্মাও ভুল করেন, আমরা তো কোন ছার। সে কথা কে বুঝছে?” পুজোর বাজার ভগীরথদের কাছে আসলে শ্রমের বাজার, যা তাঁদের বারো ঘণ্টার দক্ষ শ্রমের একটু বেশি দাম দিতে প্রস্তুত। এটুকুই দেবীর কৃপা। না কি, বাজারের?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Insurance Durga Puja 2023

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy