তসলিমা নাসরিনের পশ্চিমবঙ্গে আর ফেরা হল না। নেতারা জানিয়েছেন, ক্ষমতার লক্ষ্যে পৌঁছতে আদর্শ ধুয়ে জল খাওয়ার প্রাচীন কুপ্রথা তাঁরা ত্যাগ করেছেন। অতএব মৌলবাদী আক্রমণে তসলিমা নাসরিনের রাজ্য ত্যাগ নিয়ে আলোচনা নির্বাচনের সময়ে কিছু শিক্ষিত আদর্শবাদীর কচকচি মাত্র।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির মুখপাত্ররা কেউ বলছেন এটা জয়, কেউ বলছেন পরাজয়। একটা মত: ২০১৬-র তিন বিধায়ক থেকে ২০২১’এ ৭৭, এটা জয়। অন্য মত: ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ১২২টি বিধানসভায় এগিয়ে থেকে এখন ৭৭, এটা পরাজয়। ভোটের শতাংশ বা সংখ্যা দিয়ে আসনের হিসাব সব সময় মেলে না। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯-এর তুলনায় বিজেপির ভোট কমেছে প্রায় ২ শতাংশ, কিন্তু ২০১৯’এ এগিয়ে থাকা আসনের তুলনায় প্রাপ্ত আসন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ২০১৯’এ বিজেপি তৃণমূলের থেকে মাত্র ৩ শতাংশ-বিন্দু ভোটে পিছিয়ে ছিল, সে বারের জয়যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিজেপির প্রয়োজন ছিল একটি ভোট বিস্ফোরণ। তা হয়নি।
বেঠিক রাজনৈতিক ভাষায় কিছু কথা বলা যাক। বিজেপির ভোট বিস্ফোরণ কারা ঘটাতে পারে? হিন্দুরা। বিজেপির জয়যাত্রাকে কারা রুখে দিতে পারে? অবিভাজিত মুসলিম ভোট। মুসলিম ভোট প্রায় পুরোটাই গিয়েছে তৃণমূলে। দীর্ঘ দিন মৌলবাদকে তোষণ করে আসা, এমনকি ইসলামি ধর্মীয় নেতার দলের সঙ্গে জোট বেঁধেও বাম দল-কংগ্রেস জোটের দীর্ঘ দিন ধরে লালিত শেষ মুসলিম ভোটগুলিও জমা পড়েছে তৃণমূলের বাক্সে, কারণ রাজ্যের মুসলমান জনসাধারণ মনে করেছেন, বিজেপিই তাঁদের মূল শত্রু। বিজেপির পাওয়া সব ভোট হিন্দুদেরই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। গোদা হিসাবে তা মোট হিন্দু ভোটের ৫০ শতাংশেরও কিছু বেশি। রাজ্যের হিন্দুরা মনে করেননি, তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিজেপির কোনও বিশেষ প্রয়োজন আছে।
কিন্তু এই ভোটযুদ্ধে বিজেপিই কি বলেছিল যে, তারা ক্ষমতায় না এলে হিন্দুদের বিপর্যয় ঘটবে? পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে? না, বিজেপি এ সব ভাবাদর্শের কথায় মাথা ঘামায়নি। তাদের নির্বাচনী সঙ্কল্পপত্রে জনসাধারণকে নানা কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। ১৩ দফা প্রতিশ্রুতি তালিকার শিরোনাম ছিল: মহিলা, যুব, কৃষক, সুশাসন, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিকাঠামো, পর্যটন, সংস্কৃতি, সবার বিকাশ, নতুন কলকাতা, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও পরিবেশ। সবার জন্যই কিছু প্রাপ্তিযোগ, সুশাসনের কিছু প্রতিশ্রুতি। এই সঙ্কল্পপত্র পড়ে কেউ একেবারেই বুঝতে পারবে না রাজ্যে ইসলামি মৌলবাদের কোনও সমস্যা আছে, ধর্মীয় সন্ত্রাস হয়, পরিবর্তিত ধর্মীয় জনসংখ্যা কী বিপদ তৈরি করেছে, অনুপ্রবেশ সমস্যা কেমন, ইত্যাদি। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা কেন ভাবতে যাবেন, তাঁদের ধর্মীয় অস্তিত্বের কোনও সমস্যা আদৌ আছে, এবং তার সমাধানে বিজেপিকেই ভোট দিতে হবে?
নির্বাচনপটীয়ান নেতারা বলছেন: এ সব এখন বলার কথা নয়, সাম্প্রদায়িক তকমা ও সংখ্যালঘু ভোট— এ সব মনে রাখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য অসম। মুসলিম জনসংখ্যা ৩৪% (২০১১), পশ্চিমবঙ্গে যা ২৭% (২০১১)। এহেন রাজ্যে শাসক দল বিজেপি নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই মাদ্রাসা শিক্ষা অবলুপ্ত করে। অসম বিজেপির নির্বাচনী সঙ্কল্পপত্রে দশটি উন্নয়নমূলক প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু এ ছাড়াও ছিল একটি অংশ যার শিরোনাম: অসমের সভ্যতাকে শক্তিশালী করা। তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, এই নির্বাচনের সঙ্কল্প অভারতীয় সংস্কৃতির হাত থেকে অসমকে বাঁচানো, লাভ জেহাদ বন্ধ করা, মৌলবাদকে প্রতিহত করা। বিজেপির প্রচারের মুখ্য বিষয় ছিল: এটা সভ্যতা-সংস্কৃতির লড়াই। অসমে বিজেপি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে আদর্শের লড়াইও চালিয়েছে, অসমিয়া বাঙালি হিন্দু তাকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে।
কোনও রাজ্যে কোনও একটি দলের হার-জিতে ভারতীয় গণতন্ত্রের কিছু যায় আসে না। নির্বাচনের মাধ্যমে কাল গুজরাতে বিজেপি বা কেরলে সিপিআইএম শাসনক্ষমতা হারালে বিশেষ কিছু ঘটবে না। তা হলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পরাজয়ে বিশেষ কোনও চিন্তার প্রয়োজন আছে কি? গণতান্ত্রিক দেশে বিজেপি গঠনাত্মক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে পাঁচ বছর পরে আবার নির্বাচনে নামবে, মানুষ চাইলে শাসনক্ষমতায় আসবে।
কিন্তু না, সারা ভারতের এই মডেল পশ্চিমবঙ্গের জন্য মান্য নয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গ দেশভাগের কারণে ধর্মীয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে গঠিত একটি বিশেষ রাজ্য। আশঙ্কা হয়, এই বিজয়ের পর আগামী পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের ধর্মীয় অনুপাত আরও পাল্টে যাবে, জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে ইসলামি ঝোঁক আমাদের ভাষায় সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করবে। বামেরা চূড়ান্ত হারলেও শিক্ষাজগতে তাদের ভারতীয় সংস্কৃতি-বিরোধী চিন্তাই শাসন করবে, মৌলবাদীরা আরও আক্রমণাত্মক ও শক্তিশালী হবে। কেউ ভুলেও বলবে না যে, তসলিমা নাসরিন-বিহীন কলকাতা মৌলবাদের কাছে নতজানু কলকাতা। শ্যামাপ্রসাদ আবার চলে যাবেন বিস্মৃতির অন্তরালে। আদর্শের একটি নতুন বিস্ফোরণ না হলে পশ্চিমবঙ্গ তার অস্তিত্ব হারাবে। প্রিয় তসলিমা নাসরিন, আপাতত এই পশ্চিমবঙ্গ আপনার পদার্পণের যোগ্য নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy