Advertisement
১১ মে ২০২৪
পশ্চিমবঙ্গ ও ভূতের ভবিষ্যৎ
West Bengal Assembly Election 2021

বাঙালি কে, কে-ই বা বহিরাগত? এই বিতর্কের ফল কী হবে?

বিচিত্র: নানা সংস্কৃতির নানা মানুষের কর্মক্ষেত্র কলকাতা, সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। চিৎপুর, ১৮৬৭।

বিচিত্র: নানা সংস্কৃতির নানা মানুষের কর্মক্ষেত্র কলকাতা, সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। চিৎপুর, ১৮৬৭। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

রূপেন্দ্র নারায়ণ রায়
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:২০
Share: Save:

সাধে কি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন: “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গভরা”। এ দেশে রঙ্গের শেষ নেই! আর বিভাজনের অন্ত নেই। স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত নাটকে আবেগভরে বলেছিলেন: “বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা, জাতির সৌভাগ্য-সূর্য আজ অস্তাচলগামী; শুধু সুপ্ত সন্তান-শিয়রে রুদ্যমানা জননী নিশাবসানের অপেক্ষায় প্রহর গণনায় রত। কে তাঁকে আশা দেবে? কে তাঁকে ভরসা দেবে? কে শোনাবে জীবন দিয়েও রোধ করব মরণের অভিযান?”

নাটকে বিশুদ্ধ বাংলায় এই সংলাপটি যিনি উচ্চারণ করলেন সেই সিরাজউদ্দৌলার শরীরে এক বিন্দু বাঙালি রক্ত ছিল না! তিনি তুর্কি এবং আরবি বংশোদ্ভব ছিলেন। উৎপল দত্ত পরিহাস করে বলতেন, “বাংলা নাটকে শাজাহান এবং ঔরংজেব শান্তিপুরী বাংলায় সংলাপ বলে কিন্তু যেই কোনো ইংরেজ অথবা পর্তুগীজ মঞ্চে আসে অমনি শুরু হয়: ‘টুমি হামি, টুমি হামি’!” মোগল, তুর্কি, আরব চটজলদি বাঙালি হয়ে যায়, বহিরাগত ইউরোপিয়ানরা বিদেশি থেকে যায়!

প্রশ্ন হল, বাঙালি কে আর বহিরাগত কে?

বিজ্ঞানসাধক আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৪ সালে। বাংলা ভাষার চর্চার জন্য বিখ্যাত রামেন্দ্রসুন্দর জন্মসূত্রে বাঙালি ছিলেন না। তাঁর পূর্বপুরুষরা উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন। পশ্চিম থেকে আসা এই সম্প্রদায়ের মানুষরা রামেন্দ্রসুন্দরের জন্মের দু’শো বছর আগে থেকেই মুর্শিদাবাদে বসবাস করতেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের সকলের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়, এবং তাঁরা বাঙালিদের মতোই বাংলার চর্চা করতে শিখেছিলেন।

প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সুহৃত্তম শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী’ শিরোনামে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “হে মিত্র, পঞ্চাশৎবর্ষ পূর্ণ করিয়া তুমি তোমার জীবনের ও বঙ্গসাহিত্যের মধ্যগগনে আরোহণ করিয়াছ, আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি। যখন নবীন ছিলে তখনই তোমার ললাটে জ্ঞানের শুভ্র মুকুট পরাইয়া বিধাতা তোমাকে বিদ্বৎসমাজে প্রবীণের অধিকার দান করিয়াছিলেন। আজ তুমি যশে ও বয়সে প্রৌঢ়, কিন্তু তোমার হৃদয়ের মধ্যে নবীনতার অমৃতরস চিরসঞ্চিত। অন্তরে তুমি অজয়, কীর্তিতে তুমি অমর, আমি তোমাকে সাদর অভিবাদন করিতেছি।” রামেন্দ্রসুন্দর কি বহিরাগত ছিলেন, না বাঙালি?

শান্তিনিকেতনের মোহন সিংহ খাঙ্গুরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের এক জন বিখ্যাত গায়ক। সুদূর লুধিয়ানা থেকে এসেছিলেন বিশ্বভারতীতে সঙ্গীত সাধনা করতে। থেকে গেলেন। বাংলা ভাষায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি, প্রাণ মাতানো গায়ক— তিনি কি বহিরাগত না নিবেশিত বাঙালি? অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি বাঙালি ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে! তা হলে তাঁরা কোন দলে, অন্তর্গত না কি বহিরাগত?

এ বার আলোচনা করা যাক মারোয়াড়ি সম্প্রদায়কে নিয়ে। মারোয়াড়িরা রাজস্থানের জোধপুরের মারোয়ার অঞ্চলের একটি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সম্প্রদায়। বিখ্যাত জগৎ শেঠ ছিলেন মারোয়াড়ি। ‘জগৎ শেঠ’-এর অর্থ ‘বিশ্ব ব্যাঙ্কার’। ‘জগৎ শেঠ’ এক জন ব্যক্তির নাম নয়, এটি বংশগত রাজকীয় উপাধি। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিক চাঁদ। আঠারো শতকের শেষভাগে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্কিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জগৎ শেঠ পরিবারই ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের অর্থজগৎ নিয়ন্ত্রণ করত। পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিক চাঁদ সপ্তদশ শতকের শেষ দশকে পটনা থেকে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন এবং সরকারের পক্ষে ব্যাঙ্কার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খান ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রাজস্ব দফতর স্থানান্তর করে মুর্শিদাবাদে স্থাপন করলে মানিক চাঁদও তাঁর দফতর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। সেখানে তিনি নবাবের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও ব্যাঙ্কারে পরিণত হন। জগৎ শেঠ ক্রমে ক্রমে সরকারের একচ্ছত্র ব্যাঙ্কার হিসেবে নিজের স্থান করে নেন। সমস্ত মারোয়াড়ি সম্প্রদায় ছিল বাংলার অর্থনীতির একটি অবিভাজ্য অঙ্গ।

পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস মন্ত্রিসভার বিশিষ্ট সদস্য বিজয় সিংহ নাহার ছিলেন এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। তিনি জন্মেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ শহরে এবং অনেক তথাকথিত বাঙালি ভদ্রলোকের থেকে ভাল বাংলা বলতেন। তিনি যদি বহিরাগত হন, তা হলে কে যে বহিরাগত নয়, আমি জানি না।

আপনি বাঙালি না অবাঙালি, এই চূড়ান্ত পরীক্ষা কী ভাবে হবে? বাবা যদি বাঙালি হন আর মা অবাঙালি, তা হলেই কি শুধু পুত্র বা কন্যা বাঙালি হবেন? নোবেল পুরস্কারজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় খাঁটি বাঙালি যদিও তাঁর মা মরাঠি! কিন্তু বিখ্যাত গায়ক অরিজিৎ সিংহ (যাঁর জন্ম মুর্শিদাবাদে) তিনি কি তা হলে বাঙালি নন, যদিও তাঁর মা বাঙালি? রাহুল দেব বর্মন কি বাঙালি, না অবাঙালি? আমাদের সাংসদ এবং আমার স্কুলের ছাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন তো ঝরঝরে বাংলা বলেন, তিনিও কি তা হলে অবাঙালিদের দলে পড়বেন? বাংলা রেনেসাঁসের হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো কি বহিরাগত? সন্ত টেরিজ়া এসেছিলেন ম্যাসেডোনিয়া থেকে। সারা জীবন দরিদ্রের সেবা করেছেন কলকাতায়, শেষ নিশ্বাস ফেলেছিলেন এই শহরে। তিনি কি বহিরাগত?

কলকাতা এবং অবিভক্ত বাংলা এক সময় ছিল ভারতের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের পাট, চা শিল্প এবং অন্য কারখানাগুলি ছিল বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত অভিবাসী শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল। সরকারি এবং সওদাগরি সংস্থায় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ কলকাতায় এবং বাংলায় আসতেন। এই সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত বৈচিত্র এবং বিভিন্নতা ছিল বাংলার কৃষ্টিগত উৎকর্ষ এবং আর্থিক ঐশ্বর্যের উৎস! আমাদের রাজ্যে এবং শহরে বাসা বেঁধে ছিলেন বাগদাদ থেকে আগত ইহুদিরা, অত্যাচারিত আর্মেনিয়ানরা, আইরিশ, আমেরিকান, ফরাসি, পর্তুগিজ এবং আরও অনেকে।

পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য— ভারতের সংবিধানের ১৯ ধারা অনুযায়ী যে কোনও নাগরিক এই দেশে অবাধ বিচরণ করতে পারে। আমিও আগামী কাল গুজরাতে গিয়ে ব্যবসা বা চাকরি করতে পারি, বসবাসও করতে পারি। তেমনই তামিলনাড়ু থেকে এক জন এসে পশ্চিমবঙ্গে চাকরি করতে পারেন, ব্যবসাও করতে পারেন— বাধা নেই। যদি কেউ বলে, তুমি বহিরাগত, চলে যাও, তা হলে সে বেআইনি কথা বলছে। দণ্ডনীয় অপরাধ করছে।

একটু ভেবে দেখুন, সিলিকন উপত্যকা কেন এত প্রাণবন্ত? কেননা সান ফ্রান্সিস্কো মেধা এবং পুঁজিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। কেউ সেখানে প্রশ্ন করে না, তুমি কি বহিরাগত না স্থানীয়? সেখানে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে মেধাবী মানুষ জড়ো হয়েছে, আমাদের ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকেও। সেখানে চলছে সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের মহাযজ্ঞ। পূজারিরা আসছে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে !

যদি সেই বাজার অর্থনীতির যজ্ঞে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হয়, তা হলে প্রাচীর ভাঙতে হবে। ‘বহিরাগত’দের সেই মহাহোমের ঋত্বিক হিসেবে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে হবে। শুধু চিত্ত ভয়শূন্য হলেই চলবে না। জ্ঞানকে মুক্ত করতে হবে, গৃহের প্রাচীরকে ভেঙে ফেলতে হবে এবং আহ্বান করতে হবে দেশি এবং বিদেশি পুঁজি এবং মেধাকে। যাঁরা বাংলা ছেড়ে দেশের অন্য রাজ্যে কিংবা বিদেশে গিয়ে সফল হয়েছেন, তাঁদের অবাধ লগ্নির সুযোগ দিতে হবে। আমরা যদি এখন কে খাঁটি আর নির্ভেজাল বাঙালি নিয়ে কূটকচালি শুরু করি, তা হলে সরস্বতী (মেধা) এবং লক্ষ্মী (পুঁজি) দুই দেবতাই নিশ্চিত অপ্রসন্ন হবেন।

ফল? বাংলার ভূত অর্থাৎ অতীত, ভবিষ্যতের থেকে উজ্জ্বল দেখাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE