Advertisement
০৩ মে ২০২৪
COVID-19

আমরা পারব, এই বিশ্বাস

লকডাউনের এক বছর পেরোল। ভাইরাস একটু পিছু হটেও আবার ফিরে এসেছে। ফের হয়তো কোমর বাঁধতে হবে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের।

শ্যামল চক্রবর্তী

শ্যামল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২১ ০৪:২৯
Share: Save:

বছর তেইশের তরুণী, প্রথম সন্তান হবে। জ্বর আছে, তাই বেড পেয়েছেন প্রসূতি বিভাগের আইসোলেশন ওয়ার্ডে। সদ্য শুরু হয়েছে কোভিড ওয়ার্ড— বেড থাকলেও অ্যানাস্থেশিয়ার ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা। চার ঘণ্টা বাদে চিকিৎসক ঠিক করলেন, সিজ়ার করতে হবে। ইমার্জেন্সি সার্জন তৈরি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কী ব্যবস্থা হবে? অক্সিজেন আর নাইট্রাসের সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে ছুটল ওটি বয়। সার্জন বললেন, “রিস্ক নিতেই হবে, বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে।” আধঘণ্টা বাদে সদ্যোজাতের সঙ্গে ছবি তুললেন ডাক্তাররা।

লিফটে উঠতে গিয়ে থমকে গেলেন ডাক্তারবাবু। “তুমি জয়েন করে গেলে?” লিফটম্যান বললেন, “রিপোর্ট নেগেটিভ এসে গিয়েছে স্যর।” আরও বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ উড়িয়ে দিলেন সীতারাম। যাঁকে ফাঁকিবাজ বলে চিনত সকলে, কোভিডের দিনগুলোতে তাঁকেই ঘরে থাকতে রাজি করানো গেল না! যেমন, টানা ১৬ ঘণ্টা কাজের পরে ডেপুটি সুপার চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়লে, সুপার নিজেই কম্পিউটারে বাকি ডেটা এন্ট্রি শুরু করলেন। ঘুম ভেঙে ডেপুটি দেখলেন, কাজ শেষ। ল্যাব টেকনিশিয়ানরা ভাড়াবাড়িতে ঢুকতে বাধা পাচ্ছেন শুনে সুপার হাসপাতালেই সরকারি গেস্টহাউসে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পরের এক মাস দ্রুত বাড়ল নমুনা সংগ্রহ আর পরীক্ষা।

লকডাউনের এক বছর পেরোল। ভাইরাস একটু পিছু হটেও আবার ফিরে এসেছে। ফের হয়তো কোমর বাঁধতে হবে। কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষমতা ও দক্ষতার পরিধি কতখানি, বুঝিয়ে দিয়েছে গত বছরের অতিমারি। কোভিড খানিকটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর কোভিডযোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মীরা আজ অনুভব করছেন, ‘অসম্ভব’ বলে কোনও শব্দ হয় না। শুধু কোভিড রোগীই নয়, সব ধরনের রোগীর চিকিৎসায় একটা সময় কার্যত অঘোষিত লকডাউন করে দিয়েছিল ঝাঁ-চকচকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো।

প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে প্রথম থেকেই রাজ্য জুড়ে কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, প্রশাসকরা। দিনরাত এক করে, দাঁতে দাঁত চেপে নির্ভীক লড়েছেন ওঁরা। কয়েকশো সতীর্থকে হারিয়েও লড়াইয়ের ময়দান থেকে এক ইঞ্চিও সরে আসেননি। রাজ্য জুড়ে কোভিড ছড়ালেও পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে যায়নি, তার কৃতিত্ব সরকারি হাসপাতালেরও বটে!

কী করেননি সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা! কোভিড রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ, রোগীর সংস্পর্শে আসা সব মানুষের ঠিকানা জেনে তাঁদের খুঁজে নিভৃতবাসের ব্যবস্থা। উপসর্গ দেখা দিলেই পরীক্ষা করা, রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা, সুস্থ হয়ে ফেরার পর নিয়মিত রোগীর খোঁজ নেওয়া। সুস্থ হয়ে রোগীরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য দফতর থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া হয়েছে, জানতে চাওয়া হয়েছে সুবিধা-অসুবিধা। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ ফেরত রোগীরা বলেছেন— সুষ্ঠু চিকিৎসা, ডাক্তারবাবুর আশ্বাস পাওয়া আর সময়মতো পুষ্টিকর খাবার মেলার কথা। সরকারি কর্মীমাত্রই ফাঁকিবাজ, অসংবেদী— এই স্টিরিয়োটাইপ ভেঙে গিয়েছে।

অথচ এঁরাই ইটপাটকেলে, জনরোষে, উদ্বেগে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। নিজের বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার শঙ্কা ছিল নিত্যসঙ্গী। তার পরও বিশাল কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুরূহ কাজটি সুসম্পন্ন করেছেন। সরকারি হাসপাতালের সর্বস্তরের কর্মীরা জান কবুল করে যুদ্ধে না ঝাঁপালে অতিমারিতে রাজ্যে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বহু গুণ বাড়ত। নিখরচায় সরকারি চিকিৎসার গুণমানে হতচকিত বেসরকারি হাসপাতালগুলো এক সময় খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছিল!

সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা বুঝেছেন, কঠিন রোগ, প্রবল চাপ সামলানোর ক্ষমতা তাঁদের আছে। টিকাদানের বিপুল চাপও তাঁরা এখন অবলীলায় সামলাচ্ছেন। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা এ বার মুখ দেখুক আয়নায়। শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা আর মানবিকতা ফিরিয়ে আনতে পারলে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা সত্যিই সুস্বাস্থ্যের সোনা ফলাতে পারে। চাই শুধু নতুন উদ্যোগ। সর্বস্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাযোগ্য সুযোগসুবিধা, ভাল কাজের পুরস্কার চালু হোক। কাজে ফাঁকির শাস্তি হোক। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চাই। সরকারি হাসপাতালের প্রশাসনের হাতে দ্রুত সমাধানের চাবি থাকুক। বেসরকারিকরণ নয়, পেয়িং বেড ও কেবিন ফের চালুর ভাবনাও জরুরি। অতিমারি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তেরও ভরসা ফিরিয়েছে সরকারি হাসপাতালে। তবে তাঁরা চান সাফসুতরো শৌচাগার, ভাল ব্যবহার। তা দেওয়া যাবে না কেন? রোগার্তকে ভালবাসা, তাঁর ও পরিজনের সঙ্গে ভাল ব্যবহার অভ্যাসমাত্র। সরকারি চিকিৎসা অমিত শক্তিধর। মাথা উঁচু করে বলার দিন এসেছে, আমরাই পারি।

স্ত্রীরোগ বিভাগ, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

COVID-19 coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE