Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Poppy Seeds

কী করে ফেরানো যায় পোস্তকে

অবৈধ কাজ না করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পোস্ত চাষ হতে পারে। অনেকে প্রস্তাব দিয়েছেন, সরকারি খামারের জমিতে পোস্ত চাষ হোক।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

ধরণীধর পাত্র
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২১ ০৫:৪৩
Share: Save:

পোস্ত বড়া, আলুপোস্ত, পোস্ত বাটা— সবই যেন রূপকথা হতে বসেছে। পোস্তর দাম প্রতি কিলো আড়াই হাজার টাকা ছুঁয়েছে। কয়েক দশক আগেও বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমানে পোস্ত খাওয়ার রেওয়াজ বেশি ছিল। এখন সারা পশ্চিমবঙ্গ, এমনকি প্রবাসী বাঙালিরাও পোস্তানুরাগী। অথচ, সাধের পোস্ত চলে গিয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন এই দশা?

পোস্ত চাষে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মূল কারণটা অজানা নয়। যে ফলের বীজ পোস্তদানা বলে আমরা খাই, তা থেকেই আফিম হয়। আধপাকা ফল চিরে দিলে বেরোয় ঘন ক্ষীরের মতো আঠালো তরল (ল্যাটেক্স গাম)। তা থেকে তৈরি হয় মরফিন, যা সর্বোত্তম ব্যথানাশক, ক্যানসার রোগী-সহ নানা যন্ত্রণাকাতর মানুষের চিকিৎসায় যার ব্যবহার হয়। মরফিন-সহ চার রকম ‘ওপিয়েট’, যেগুলি মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডকে প্রভাবিত করে ব্যথার উপশম করে, তন্দ্রা ও প্রশান্তি আনে, সেগুলি কেবল ‘ওপিয়াম পপি’ থেকেই পাওয়া যায়। সেই জন্য পোস্ত গাছ বা পপিকে ঔষধি-বনস্পতির মধ্যমণি মনে করা হয়। কিন্তু মরফিন, এবং তা থেকে তৈরি হেরোইন, তীব্র মাদকাসক্তি জন্মাতে পারে। তাতে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়, বেশি মাত্রায় নিলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই সারা বিশ্বেই পোস্ত চাষ কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ভারতে আইন অনুসারে (নার্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্ট, ১৯৮৫) চাষিরা তাঁদের উৎপাদিত পোস্ত বীজ এবং ল্যাটেক্স গাম কেবলমাত্র নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বোর্ডকে বিক্রি করতে পারেন। প্রতি হেক্টর জমিতে কত পোস্ত উৎপন্ন হবে, তার মাপ সরকার বেঁধে দেয়। হেক্টর প্রতি ৫৩ কিলোগ্রাম (মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে) এবং ৪৫ কিলোগ্রাম (উত্তরপ্রদেশে) পোস্ত উৎপাদন করার ক্ষমতা যাঁরা রাখেন, শুধু তাঁরাই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য। নির্দিষ্ট পরিমাণ পোস্ত যদি চাষি না বিক্রি করতে পারেন, তাঁর লাইসেন্স নবীকরণ হবে না।

ভারতে নার্কোটিক্স বোর্ড কেবল একটিই প্রজাতির পোস্ত (কনসেন্ট্রেটেড পপি স্ট্র) চাষের অনুমতি দেয়, যেটিতে আফিম উৎপাদনের আঠা বেরোয় সামান্য। অসাধু চাষি অবশ্য সেটুকুও সংগ্রহ করে মাদকদ্রব্য তৈরির কাজে লাগাতে পারেন, তাই নজরদারি জারি রাখতে হয়। প্রধানত তিনটি রাজ্যে বৈধ ভাবে পোস্ত চাষ হয়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গে পোস্ত চাষ বৈধ নয়, তা সত্ত্বেও মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমে অল্পবিস্তর পোস্তর চাষ হয়। মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের কোনও কোনও এলাকায় ল্যাটেক্স গামও নিষ্কাশিত হয়। সে সব এলাকা এমন অপরাধপ্রবণ যে, পুলিশও সেখানে ঢুকতে পারে না। ভারতীয়দের পোস্তর চাহিদার সিংহভাগ জোগান দেয় আফগানিস্তান, মায়ানমার এবং কিছু অন্য দেশ।

স্থানীয় বাজারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না পোস্তর দামে, এই জন্য দাম থাকে চড়া। তার উপর এখন অনেকগুলি দুর্ভাগ্যজনক কারণ একত্র হওয়ায় পোস্ত অগ্নিমূল্য হয়েছে। এক, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য পোস্ত আমদানি কমেছে। দুই, দেড় বছর ধরে ‘লকডাউন’-এর ফলে অনেক চাষি সময়মতো পোস্ত বিক্রি করতে পারেননি। বাড়িতে বা গুদামে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। মজুত রাখলে পোস্তর গুণ খারাপ হতে পারে, বেশি শুকিয়ে গেলে ওজন কমে যায়, পোকার আক্রমণ হয়। চাষির লাইসেন্স হারানোর ঝুঁকি বেড়েছে। তিন, সরকারও ঠিক সময়ে পোস্ত কিনতে পারেনি, ফলে পোস্ত বাজারে আসেনি। চার, পোস্ত প্রক্রিয়াকরণের বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

পোস্তর চাষ কী করে বাড়ানো যায়? বিজ্ঞানীরা চেয়েছিলেন এমন কোনও প্রজাতির উদ্ভাবন, যাতে পোস্তর সব গুণ বিদ্যমান কিন্তু আফিমরহিত। লখনউয়ের ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব মেডিসিনাল অ্যান্ড অ্যারোম্যাটিক প্লান্টস’-এর বিজ্ঞানীরা একটি প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন (সুজাতা), যাতে পোস্ত বীজ ও তেলের উৎপাদন ও গুণাগুণ বিদ্যমান কিন্তু ফল থেকে আফিম তৈরি হয় না। মুশকিল হল, আফিমরহিত গাছের পাপড়ি, গাছ, ফুলফল দেখতে আফিমযুক্ত গাছের মতোই। কিছু অসাধু পোস্তচাষি নতুন প্রজাতির সঙ্গে মিশিয়ে আফিমযুক্ত পোস্তও চাষ করতে লাগলেন।

বাঙালির পাতে পোস্ত আবার সুলভে মিলতে পারে, বাংলার চাষিও পোস্ত চাষ করে লাভের মুখ দেখতে পারেন, যদি আইন পালনের বিষয়ে কৃষক ও সরকার এগিয়ে আসে। উর্বর, উঁচু জমি, যেখানে সেচের ব্যবস্থা আছে, সেখানে পোস্তর চাষ করা যেতে পারে। বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, জলপাইগুড়িতে পোস্ত চাষ লাভদায়ক হতে পারে। সরকারি অনুমোদন নিয়ে, অবৈধ কাজ না করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পোস্ত চাষ হতে পারে। অনেকে প্রস্তাব দিয়েছেন, সরকারি খামারের জমিতে পোস্ত চাষ হোক। সম্প্রতি কৃষকরা নিজেরাই কোম্পানি তৈরি করে সদস্যদের ফসলের গুণাগুণ নিয়ন্ত্রিত করছেন। তাঁরাও দায়িত্ব নিয়ে পোস্তর চাষের তত্ত্বাবধান করতে পারেন। অন্য রাজ্যের চাষি যদি পারেন, বাংলার চাষিই বা পারবেন না কেন?

প্রাক্তন উপাচার্য, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poppy Seeds
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE