Advertisement
০৩ মে ২০২৪
ভারতের পক্ষে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন কাজ, কিন্তু উপায়ান্তর নেই
India

এ বড় সুখের সময় নয়

এক ইউক্রেনেই ত্রাহি রব! তাই, বলা নিষ্প্রয়োজন, ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফের এমন ঘটলে, অশেষ অমঙ্গল ভারতের সর্বস্তরে।

যৌথ: অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, টোকিয়ো, ২৪ মে। রয়টার্স

যৌথ: অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, টোকিয়ো, ২৪ মে। রয়টার্স

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২২ ০৪:৪৭
Share: Save:

যে গর্জন শোনা যাচ্ছে, তার অর্ধেক বর্ষণ হলেও জল কানের উপরে উঠবে। ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে আজ যে ভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে বাতাস, তাতে চালে সামান্য ভুল হলে, বা নিরাপত্তায় লৌহপ্রাচীর গড়তে না পারলে এই অঞ্চলে তৈরি হবে আর একটা ইউক্রেন।

এক ইউক্রেনেই ত্রাহি রব! তাই, বলা নিষ্প্রয়োজন, ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফের এমন ঘটলে, অশেষ অমঙ্গল ভারতের সর্বস্তরে। সেই আশঙ্কা গোপন করছেন না আঞ্চলিক রাষ্ট্রনেতারা। সম্প্রতি এশিয়ার আকাশে যা দেখা গেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হওয়া বহু চলচ্চিত্রের ফ্রেমে আজকের প্রজন্ম তা দেখে অভ্যস্ত। চিন-বিরোধী মহা শক্তিশালী আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের চর্তুদেশীয় মহাজোট (কোয়াড) টোকিয়োর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষে বক্তৃতা, সঙ্কল্প, বিবৃতির ঝড় তুলছে। ইউরোপকে এই অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করার ডাক দিচ্ছে। আর ঠিক সেই সময় টোকিয়োর এয়ার স্পেস-এর কান ঘেঁষে, আকাশে চক্কর দিচ্ছে চিন এবং রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর এই সামরিক যৌথতার সগর্ব প্রদর্শন এই প্রথম।

ব্যাঘ্রের সেই দেশজ উপমাটি কি ড্রাগনের ক্ষেত্রেও খাটে? সুস্থ সবল ড্রাগনের তুলনায় আহত ড্রাগন কি অধিক বিপজ্জনক নয়? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টোকিয়োতে পৌঁছে সেখানে বসবাসকারী ভারতীয় সম্প্রদায়ের গাত্র উষ্ণ করতে বললেন বটে, “আমার লালন পালন সংস্কার এমনই যে মাখনে দাগ টেনে কোনও আনন্দ পাই না। আমার অভ্যাস পাথরে আঁচড় কাটা।” আকাশ থেকে সামরিক বিমানের একাধিক রিমোট সেন্সিং চক্ষু-কর্ণের কাছে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে ঠিক কী বার্তা পৌঁছলো? প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, টোকিয়োর আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন কক্ষে এ বারের প্রবল কোয়াড-নির্ঘোষের পর আগামী দিনে কি পাল্টা আশা করতে পারে বিশ্ব?

চলতি বছরের গোড়ায় চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর প্রমত্ত ঘোষণা: তাইওয়ান প্রণালীর দুই দিকের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দিয়েছিলেন। তার পর, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তিন সপ্তাহ আগে মস্কো-বেজিং যৌথ ঘোষণাপত্রে জানিয়েছিল, সমস্ত রকম সহযোগিতায় তারা একে অন্যের পাশে রয়েছে। সোজা কথায়, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সাহায্যের বিনিময়ে চিন চেয়েছিল তাইওয়ান প্রশ্নে মস্কোর সমর্থন। এটাও মস্কো সে সময় চিনকে বুঝিয়েছিল, যুদ্ধ চটজলদি শেষ হয়ে যাবে, মস্কোর পরাক্রমের সামনে দ্রুত নতি স্বীকার করবে সে দেশের বর্তমান সরকার। নেটো এবং আমেরিকাকে সবক শেখাতে বেশি সময় লাগবে না। চিন হয়ে উঠবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তি।

যুদ্ধের প্রাথমিক ধাক্কার পর স্পষ্ট, সব কিছু চিত্রনাট্য মেনে চলছে না। কিন্তু এ কথাও একই ভাবে স্পষ্ট, চিন ও রাশিয়া খোলাখুলি পশ্চিমের বিরুদ্ধে এক সঙ্গে যে ভাবে কৌশলগত এবং সামরিক সংযোগ বাড়িয়ে চলছে, এবং অদূর ভবিষ্যতে তা তীব্রতর হবে। পশ্চিম বিশ্বের কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য তারা একযোগে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত সব রকম অস্ত্র প্রয়োগ করবে। মস্কো এবং বেজিং— কমবেশি আহত রাষ্ট্র এই মুহূর্তে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কখনও পুরোপুরি সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। আবার চিনও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অতীতের রাজবংশের গ্লানিময় স্মৃতিকে মুছে ফেলে এক নতুন সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায়। তবে দু’পক্ষেরই শত্রু এই মুহূর্তে যে হেতু এক, এও সম্ভব যে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরে কোয়াড-এর ডানা ছাঁটতে বেজিং মস্কোকে নিজের একটি দাঁড়ার মতো ব্যবহার করবে। এও লক্ষণীয়, এই অঞ্চলে তেরোটি দেশকে নিয়ে আমেরিকা একটি পলকা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (ইন্দো-প্যাসিফিক ইকনমিক ফ্রেমওয়ার্ক) তৈরি করলেও নিজেদের মধ্যে কৌশলগত অক্ষ নেই এখনও।

কোয়াড-এর অন্যতম সদস্য ভারতের কাছে এ বড় সুখের সময় নয়। প্রথমত, কোয়াড-এর অন্য সদস্য আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো চিন তার কাছে দূরের কোনও নক্ষত্র নয়, ঘাড়ের পাশে অহরহ নিঃশ্বাস ফেলা, দীর্ঘ সীমান্ত ভাগ করা প্রতিবেশী। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এক অবিচ্ছেদ্য সামরিক নির্ভরতার সম্পর্ক, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বই কমেনি। চিনের সঙ্গে হিমালয়ে সংঘাতে তো চিরসন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি। এটাও ঠিক যে, আজ আমেরিকা এবং ইউরোপ কোল পেতে বসতে দিতে চাইছে ভারতকে, তা যে নিজ নিজ স্বার্থে এটা না বুঝতে পণ্ডিত হতে হয় না। পাকিস্তানের, এমনকি চিনের সঙ্গেও ভারতের রক্তপাতের ধারাবাহিক ইতিহাসে পশ্চিমের ভূমিকা সবার জানা। ‘ভাল তালিবান, খারাপ তালিবান’ তত্ত্ব তারা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরেছে নিজের নিরাপত্তা এবং শেষ পর্যন্ত সওদাগরি স্বার্থের কারণে। আজ চিন মাথাচাড়া দিয়ে না উঠলে ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য এত উদ্বেগ উথলে উঠত না পশ্চিমের।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছর দশেক পর ‘জাভা যাত্রীর পত্র’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “বিজ্ঞানের স্পর্ধায়, শক্তির গর্বে, অর্থের লোভে, পৃথিবী জুড়ে মানুষকে লাঞ্ছিত করবার এই-যে চর্চা বহুকাল থেকে য়ুরোপ করছে, নিজের ঘরের মধ্যে এর ফল যখন ফলল তখন আজ সে উদ্বিগ্ন। তৃণে আগুন লাগাচ্ছিল, আজ তার নিজের বনস্পতিতে সেই আগুন লাগল।” আজ একশো বছর পরেও কতটাই না সমসাময়িক লাগে এই আপ্তবাক্যগুলি। শুধু সে দিনের মদগর্বী ইউরোপের জায়গা নিয়েছে আমেরিকা। ফলে তার অধীনে কোয়াড-এ চিনের বিরুদ্ধে পেশি আস্ফালন না করেও উপায় নেই, করলেও বিপদ সমূহ।

অন্য দিকে, চিন-রাশিয়া দুই কমিউনিস্ট দেশের জোড়া ফলা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গে আজও সুপ্রযুক্ত মুজতবা আলি সাহেবের কমিউনিস্ট এবং ক্যাপিটালিস্ট-এর মধ্যে অপূর্ব সেই কল্পিত সংলাপ। যেখানে দুই বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ তুলে বলা হচ্ছে, “আসল মারটা তো আসে লড়াই শেষ হয়ে যাওয়ার পর। তখন আরম্ভ হয় অভাব-অনটন, বেকার-সমস্যা, রোগ-শোক, মহামারী। প্রত্যেকটা দেশ তখন চেষ্টা করে নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য, সর্বপ্রকার সহযোগিতা তখন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এক দেশে মন মন ধান নষ্ট হয় খাওয়ার লোক নেই বলে, আরেক দেশে লক্ষ লক্ষ লোক মরে খাবার চাল নেই বলে।”

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে অভূতপূর্ব খাদ্যসঙ্কট তৈরি হতে চলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, তা এক ধাক্কায় বহুগুণ বেড়ে যাবে যদি ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জমা হওয়া পুঞ্জীভূত বারুদে কোনও দেশলাই স্পর্শ ঘটে। সেই আশঙ্কা সব রাষ্ট্রনেতাই করেছেন সাম্প্রতিক সম্মেলনে, যদিও এর কোনও সরল সমাধান নেই।

ভারত এখনও পর্যন্ত তার নির্জোট অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝছে। নিউ ইয়র্কে নয়নাভিরাম ইস্ট রিভার-এর ধারে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাসাদোপম কার্যালয়ে, বহু মিত্র রাষ্ট্রের পথে হেঁটে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনও কটু কথা শোনা যায়নি ভারতের মুখে। ঝড় চলার সময় মধ্যমপন্থা নেওয়া ভাল, কিন্তু তারও তো ইতর বিশেষ আছে। হাওয়ার দাপট তীব্র হলে নিজেকে বাঁচাতে হিসাব করে সুবিধামতো কোনও এক দিকে হেলে থাকা আছে। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের মডেলটিকে সামনে রাখার কথা বিবেচনা করতে পারেন সাউথ ব্লকের কর্তারা। চিন এবং ভিয়েতনাম— দুই রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নিয়মিত আদানপ্রদান এবং সম্পর্ক দিব্য উত্তম। কিন্তু হ্যানয়, দক্ষিণ চিন সাগরে নিজস্ব অধিকারের দাবিতে অটল এবং আগ্রাসী। চিনের দিক থেকে আসা ধারাবাহিক খোঁচাকে প্রশমিত করতে অক্লেশে হাত মিলিয়েছে জাপানের নেতৃত্বাধীন ট্রান্স প্যাসিফিক জোটে। সম্প্রতি তাদের আমেরিকার তৈরি ইন্দো-প্যাসিফিক ইকনমিক ফ্রেমওয়ার্ক-ও শামিল হতে দেখা গেল। আবার ভিয়েতনামের সঙ্গে রাশিয়ার যে কিছু কম ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, এমনটা তো নয়। ইতিহাস জানে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আগাগোড়া মস্কো পাশে ছিল হ্যানয়ের। কিন্তু সময়ের বাস্তবতা অনুধাবন করে, আমেরিকার সঙ্গে বিষয়-ভিত্তিক জোট করতেও তার বাধেনি।

ভিয়েতনাম এমন ক্ষিপ্র ও প্রকৃত ভারসাম্যযুক্ত অবস্থান নিলে ভারতেরও কি তা করা উচিত নয়? বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, চিন এবং রাশিয়ার অক্ষ দৃঢ়তর হচ্ছে, তখন রাশিয়া সম্পর্কে স্থায়ী ভাবে নৈর্ব্যক্তিক থাকাটা কতটা যুক্তিযুক্ত— প্রশ্ন উঠছে। বরং কোয়াড রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে যাতে স্থায়ী সামরিক ও কৌশলগত কাঠামো তৈরি করে, সে ব্যাপারে ভারতের সক্রিয়তা বাড়ানো উচিত। সে ক্ষেত্রে তারও মস্কোর উপর প্রবল সামরিক-নির্ভরতা কমতে পারে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

India PM Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE