করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা ছাড়াও অনেকগুলি দিক থেকে দেখলেই বিদায়ী বছরটি স্মরণে রাখার মতো। বহু পরিবারকেই স্বজন হারানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা পেরোতে হয়েছে। অন্য দিকে লকডাউন-পরবর্তী আয়-সঙ্কোচন অনেক পরিবারকে বিধ্বস্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এরই মধ্যে সাম্প্রতিকতম বিধানসভা নির্বাচনটি দেখলেন। অতিমারির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের উদ্যাপন। তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ইস্তাহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মেনে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু করল। ব্যাপ্তি এবং প্রভাবের দিক থেকে দেখলে প্রকল্পটির গুরুত্ব যদিও কম নয়, এর ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা তেমন দেখিনি। যা দেখেছি তা এক অতি সরলমনা অবস্থান— রাজকোষ উজাড় করে দানখয়রাতি করে সরকার দেউলিয়া হওয়ার পথে হাঁটছে। বিরোধী দলগুলির এই সমালোচনায় অবশ্য রাজ্যবাসীর গরিষ্ঠ অংশের বিশেষ মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না, কারণ পরিবার দেউলিয়া হলে কী হতে পারে তার খানিক আন্দাজ আমরা করতে পারি, কিন্তু দেশের একটি অঙ্গরাজ্য দেউলিয়া হলে ঠিক কী পরিণতি হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।
নির্বাচনী প্রতিযোগিতার স্বাভাবিক নিয়মেই প্রায় সব রাজনৈতিক দলই তাদের ইস্তাহারে কর্মসংস্থান থেকে নগদ হস্তান্তর— এমন নানান সুযোগসুবিধার প্রতিশ্রুতি কমবেশি দিয়েছিল। সরাসরি নগদ অর্থ বণ্টন রাজনীতিকদের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই ভারী আকর্ষণের বস্তু। কারণ তাঁরা মনে করেন এ ভাবে আনুগত্য নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু শুধু এই কারণে নগদ হস্তান্তরের বিরোধিতা করারও মানে হয় না। যে মহিলার নিজের রোজগার নেই, অথবা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর দিনান্তে সামান্য কিছু জোটে যাঁর, তাঁর কাছে এই পাঁচশো টাকার গুরুত্ব যে অসীম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মজা পাই যখন দেখি, কোনও বিরোধী দল এই ধরনের প্রকল্পের সমালোচনা করতে গিয়ে যে যুক্তিটি এনে ফেলে, তা সমাজের উচ্চবেতনভুক সম্প্রদায়ের অধিকাংশের মানসিকতার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। গরিবরা ‘এমনি এমনি’ টাকা পাচ্ছে দেখলে এই শ্রেণির মানুষ অস্থির হয়ে ওঠেন। তিরিশ দিন অন্যের বাসন মেজে তবেই এক জন হাজার টাকা পেতে পারেন, এটাই যখন নিয়ম, সেখানে কিছু না করেই পাঁচশো? শিল্প নেই, চাকরি নেই, শুধুই টাকা বিলিয়ে ভোট কেনা! যেন লক্ষ্মীর ভান্ডারের ওই টাকাটুকু মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে না ঢুকলে শিল্পের রথ গড়গড়িয়ে চলত।
এটি হচ্ছে বলেই ওটি হতে পারছে না— এই সহজ কার্য-কারণ সম্পর্কে উপনীত হওয়ার আগে একটু তলিয়ে ভেবে দেখা যাক। শিল্প হচ্ছে না কেন তার ছত্রিশটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সরাসরি কল্যাণমুখী ব্যয়ের কারণে যে তা হচ্ছে না তা প্রমাণ করা শক্ত। মনে রাখতে হবে, নগদ টাকা হস্তান্তরে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়— কেউই আপত্তির কারণ দেখেন না। তবু সদা-সন্দেহাকুল বুঝদার মানুষের মনে প্রশ্ন একটা থেকেই যায়, এত টাকা আসবে কোত্থেকে? সরকার কি এ জন্যে ‘দেউলিয়া’ হয়ে যাবে না? ২০২১-২২ আর্থিক বছরের বাজেটে লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সাত হাজার কোটি টাকা। ওই টাকায় সমস্ত শর্ত মেনে প্রায় দু’কোটি মহিলার অ্যাকাউন্টে মাসে মাসে ৫০০ (তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য ১০০০) টাকা দেওয়া যাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত। এ পর্যন্ত এই প্রকল্পে নথিভুক্তির অগ্রগতির হার যে রকম দেখছি, মোট প্রাপকের সংখ্যা দু’কোটির অনেকটা কমই হবে বোধ হয়। অতএব খরচও সাত হাজার কোটি হবে না। ২০২১-২২’এ রাজকোষে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬০,৮৬০ হাজার কোটি টাকা, যা রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (যাকে জিএসডিপি বলা হয়) ৪.০৩ শতাংশ। লক্ষ্মীর ভান্ডারের সাত হাজার কোটি বাদ দিলে ঘাটতি দাঁড়াত ৫৩,৮৬০ হাজার কোটি। বছরের শেষে যখন হিসাব কষে দেখা হবে, তখন মোট ঘাটতির পরিমাণ একে ছাপিয়েও যেতে পারে— কোভিড-পরবর্তী এ রকম অস্বাভাবিক সময়ে যা স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্যই যে ঘাটতির পরিমাণ লাগামহীন বেড়ে উঠে সরকারকে ঋণে জর্জরিত করে দেউলিয়ায় পরিণত করবে, তা বলা যায় না। কারণ, মোট ঘাটতি বাড়লেও লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ চলতি বছরে সাত হাজার কোটি ছাড়াবে না কিছুতেই। আগামী বছর থেকে অবশ্য লক্ষ্মীর ভান্ডার বাবদ প্রয়োজন হবে বারো হাজার কোটি টাকা।