Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Coronavirus in India

পুরনো শত্রু, নতুন লড়াই

জনসমাজে কোভিডের গ্রাফ যেমনই হোক না কেন, কোনও ব্যক্তি কোভিডে আক্রান্ত হলে তার যা কিছু কর্তব্য, সেগুলি আগের মতোই পালনীয়।

শ্যামল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২২ ০৪:৩১
Share: Save:

আবার সে এসেছে ফিরিয়া। তবে সেই পুরনো রূপে, না কি নতুন কোনও অবতারে? ক্রমাগত নিজেকে বদলে নিত্যনতুন প্রজাতির জন্ম দিচ্ছে কোভিড। তার নিরূপণ আজও সহজ নয়— ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য ‘জাতীয় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ’ কর্মসূচির দাবি উঠলেও কেন্দ্রীয় সরকার তিন বছর চোখে আঙুল, কানে তুলো দিয়ে কাটিয়ে দিল। রাজ্য সরকার কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে বিশেষ ভাইরাস গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করলেও, যে ভাইরাস এখন ছড়াচ্ছে সেটা ‘মামুলি’ ওমিক্রন না অন্য কোনও প্রজাতি, তা জানতে কেন্দ্রের একটি পরীক্ষাকেন্দ্রই সবেধন নীলমণি। ইতিমধ্যে ইজ়রায়েলের এক দল বিজ্ঞানী করোনার নতুন একটি প্রজাতি খুঁজে পেয়ে জানিয়েছেন, ভারতের অন্তত তেরোটি রাজ্যে এই প্রজাতির ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। এই প্রজাতি মানুষের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর, এ সব নিয়ে গবেষণা এগোনোর আগেই হীরকরাজের ‘গবেষক’-এর দল জানিয়ে দিয়েছে, ভাইরাস বদলালে নতুন প্রজাতি তো আসবেই, এ নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই। গত ঢেউতেও ওমিক্রনের আড়ালে ঢুকে পড়েছিল ডেল্টার ভয়ঙ্কর প্রজাতি, এ বারও তেমন কিছু হওয়া অসম্ভব নয়। রোগের শিকার যত বাড়ে, ভাইরাসও তত নিজেকে বদলে ফেলে, এ কথা এখন স্কুলপড়ুয়ারাও জেনে গিয়েছে। কিন্তু সমাজে সেই জ্ঞানের প্রতিফলন মিলছে কি?

ডাক্তারদের আশঙ্কা সত্যি করে দেশ জুড়ে কোভিডে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কুড়ি হাজার পেরিয়েছে। এক দিনে এ রাজ্যে করোনা ভাইরাসের শিকার প্রায় তিন হাজার মানুষ। র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট পজ়িটিভ মানুষের সংখ্যার চাইতে বাস্তবে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। সামান্য জ্বর, সর্দি, গলাব্যথা নিয়ে অনেকেই পরীক্ষা করাতে চাইছেন না। বিশেষ করে ডাক্তারদের একাংশের মধ্যেও এমন অনীহা দেখা যাচ্ছে, যা আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। যাঁরা উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গে ভুগছেন, তাঁরা পরীক্ষা না করিয়ে আশেপাশের মানুষের মধ্যে কোভিড ছড়াচ্ছেন। ধরে নিচ্ছেন, অন্যের ক্ষতি হবে না, হলেও এমন কিছু বাড়াবাড়ি হবে না। এটা ঠিক যে, করোনা আগের মতো মারাত্মক রূপে এখনও দেখা দেয়নি, কিন্তু এও ঠিক যে, সব কোভিডের রোগীই করোনার তুলনামূলক ভাবে দুর্বল প্রজাতির শিকার হবেন, এমন নয়। তৃতীয় ঢেউতে মোট আক্রান্তের একটা ছোট অংশ হৃদ্‌যন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র বা কিডনির জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন, এঁদের অনেকে এখনও নানা উপসর্গে ভুগছেন।

জনসমাজে কোভিডের গ্রাফ যেমনই হোক না কেন, কোনও ব্যক্তি কোভিডে আক্রান্ত হলে তার যা কিছু কর্তব্য, সেগুলি আগের মতোই পালনীয়। নিভৃতবাসে কয়েকটা দিন থাকা, বিশ্রাম ও সুষম খাবার খাওয়া এ বারও জরুরি। আগামী দশ বছর বা তারও বেশি সময় কোভিডের ভাইরাসকে সঙ্গী করেই দিন কাটাতে হবে আমাদের। জ্বর, সারা শরীরে ব্যথা, গলাব্যথা, অকারণ দুর্বলতা বা অন্য উপসর্গ থাকলে রক্তপরীক্ষা করা চাই, পজ়িটিভ এলে চিকিৎসা করার পর্বটিও আগের মতো,

কোনও মতেই এড়ানো যাবে না। নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজের চিকিৎসা করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকাই ভাল। আরও বেশি কোভিড পরীক্ষা চাই, বিশেষ করে যে সব এলাকায় রোগীর সংখ্যা বেশি। এএনএম ও আশাকর্মীদের সাহায্যে গ্রামেগঞ্জে কোভিড পরীক্ষা, ও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সমীক্ষা শুরু করা জরুরি। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ বা সিভিক ভলান্টিয়ারদের আগের মতোই সক্রিয় হতে হবে।

এত দিনে স্পষ্ট হয়েছে, সার্বিক চিত্র কতখানি নির্ভর করে ব্যক্তির নিয়মপালনের উপর। রুটি-রুজির ব্যবস্থা বজায় রাখা, মুখ থুবড়ে পড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে চালু রাখা জরুরি বলেই নিয়ম মানতে হবে। আশ্বাসের কথা, কম বয়সিদের মধ্যে কোভিডের আক্রমণ নগণ্য। চোদ্দো থেকে সতেরো বছরের স্কুলপড়ুয়াদের একটা বড় অংশ কোভিডের টিকার দু’টি ডোজ় পেয়েছে। এখনই স্কুল-কলেজ বন্ধ করার কোনও কারণ নেই। বরং সরকার এ বার কোভিডবিধি মেনে চলতে নাগরিকদের সামান্য চাপ দিতে পারে। আগের তিনটি ঢেউতে হাজার আবেদন-নিবেদনেও যথেষ্ট কাজ হয়নি। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, গণপরিবহণ বা ব্যস্ত রাস্তায় মাস্ক না-পরলে জরিমানা চালু করা যায়। বিশেষত রেল ও মেট্রো রেলের প্রবেশপথেই আটকাতে হবে মাস্কহীন যাত্রীদের। দীর্ঘ ফ্লাইট-পথে যাত্রীরা নিয়ম মেনে মাস্ক পরে থাকছেন, তা হলে সামান্য মেয়াদের বাস-মেট্রোতে মাস্ক পরা কেন কঠিন হবে? মাস্ক-বিরোধী প্রচার চালিয়ে আগের বার কেউ কেউ ‘বিপ্লবী’ হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা কতটা ভ্রান্ত, তা প্রমাণিত। এই বিভ্রান্তি-বিতরণকারীদের দৃঢ় ভাবে প্রতিরোধ করাই নাগরিকের কর্তব্য। নেতা-মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা মাস্ক পরলে সেই দৃষ্টান্ত মানুষকে উৎসাহিত করবে।

আর একটি জরুরি কথা— ডায়াবিটিস, বেশি রক্তচাপ, ফুসফুসের অসুখ, হৃদ্‌রোগ বা কিডনির অসুখ থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে সমস্যাকে। গোটা কোভিড কালেই এই রোগগুলির প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন, অন্য সময়ের চাইতেও বেশি। গত দু’বারের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত, এই দীর্ঘমেয়াদি অসুখগুলি নিয়ন্ত্রণে থাকলে কোভিডের মারণশক্তি প্রতিহত করা সহজ হয়। তাই ডাক্তারের পরামর্শের অনুসরণ, সতর্কতার দৈনন্দিন অভ্যাস, আর পরস্পরের প্রতি সহায়তার হাত, এই দিয়ে ফের মোকাবিলা করতে হবে এ বারের কোভিড ঢেউকে।

স্ত্রীরোগ বিভাগ, আর জি কর মেডিক্যাল

কলেজ হাসপাতাল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus in India covid 19 india COVID19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE